বিশ্ব অর্থনীতি জুড়ে সরকারি ব্যয়ের চাপ, ঋণের বোঝা এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন নিয়ে আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগকারীরা নতুন করে ঝুঁকছেন এমন সম্পদের দিকে, যা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে — স্বর্ণ ও বিটকয়েন।
মুদ্রা আস্থাহীনতা ও বিকল্প সম্পদে ঝোঁক
“ডিবেসমেন্ট ট্রেড” নামে পরিচিত এই প্রবণতায়, বিনিয়োগকারীরা মার্কিন ডলারসহ বিভিন্ন ফিয়াট মুদ্রা থেকে পুঁজি সরিয়ে নিচ্ছেন সীমিত সরবরাহের সম্পদে। বিশেষ করে বিটকয়েন, যার মোট সরবরাহ স্থির ২১ মিলিয়ন কয়েনে, বিনিয়োগকারীদের কাছে নতুন নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে।
সিটাডেল কোম্পানির সিইও কেন গ্রিফিন সতর্ক করে বলেছেন, “আমেরিকার অর্থনীতি এখন অতিরিক্ত প্রণোদনা ও ঋণের ‘চিনি-নেশা’-য় চলছে।” তাঁর মতে, বিনিয়োগকারীরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে সরে এসে ‘হার্ড অ্যাসেট’-এ ঝুঁকছেন — যা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।
সোনা ও বিটকয়েনের রেকর্ড উত্থান
২০২৫ সালের মধ্যেই বিটকয়েনের দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার ছুঁয়েছে, আর সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩,৯০০ ডলার পেরিয়ে ৪,০০০ ডলারে ঠেকেছে। বিপরীতে, মার্কিন ডলার সূচক বছরের শুরু থেকে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে — যা গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতন।
এই পতন বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা প্রকাশ করছে, বিশেষ করে যখন মার্কিন ঋণ ৩৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্যমানের উপরে অবস্থান করছে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা
এ প্রবণতা শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তথ্য বিশ্লেষক সোসভ্যালুর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বিটকয়েন-সমর্থিত স্পট ইটিএফে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পুঁজি প্রবাহিত হয়েছে। এর মাধ্যমে বিটকয়েন এখন আর কেবল ‘জুয়া-মূলক’ সম্পদ নয়, বরং বৈধ ম্যাক্রো-হেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
একই সময়ে, বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের রিজার্ভে ১,২০০ টনেরও বেশি সোনা যুক্ত করেছে — যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ গতির স্বর্ণ ক্রয় বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল।
SPI অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের স্টিফেন ইনেস বলেছেন, “এটি কোনো আবেগনির্ভর দৌড় নয়, বরং মুদ্রার ক্ষয়ের যুক্তিসঙ্গত প্রতিক্রিয়া। এখন বিনিয়োগকারীরা মুনাফা নয়, নিরাপত্তা খুঁজছেন।”
খনিশিল্প ও ক্রিপ্টো কোম্পানির লাভ
এই রূপান্তরে সোনা উত্তোলনকারী কোম্পানি যেমন নিউমন্ট, ব্যারিক ও অ্যাগনিকো ঈগল মাইনস্ বিপুল মুনাফার পূর্বাভাস পেয়েছে, তেমনি ক্রিপ্টো প্ল্যাটফর্ম কয়েনবেসও রেকর্ড ট্রেডিং ভলিউম রিপোর্ট করেছে।
ব্ল্যাকরক্ ও ফিডেলিটির মতো প্রাতিষ্ঠানিক জায়ান্টরাও এখন নতুন ইটিএফ পণ্য আনছে — সোনা-সমর্থিত ও বিটকয়েন-ভিত্তিক ফান্ড, ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে।
ব্যাংক ও ডলার ব্যবস্থার জন্য সতর্ক সংকেত
তবে এই প্রবণতা মার্কিন ব্যাংক ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যখন ডলার-ভিত্তিক সঞ্চয় কমছে এবং বিকল্প সম্পদে প্রবাহ বাড়ছে, তখন জেপি মরগান ও সিটিগ্রুপের মতো ব্যাংকগুলো লেনদেন ও তারল্য সংকটে পড়তে পারে।
এটি আমেরিকার বহু পুরনো ‘বিশেষ সুবিধা’—বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদার কারণে কম সুদে ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা—ক্ষয়ের মুখে ফেলছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুরুতে বৈশ্বিক রিজার্ভে ডলারের অংশীদারি ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা দুই দশক আগে ছিল ৭১ শতাংশ।
ডিজিটাল সম্পদের ত্বরান্বিত পরিবর্তন
ইতিহাস বলছে, এমন পরিবর্তনে সাধারণত দশক লাগে — যেমন ব্রিটিশ পাউন্ড থেকে ডলার প্রাধান্যে আসতে লেগেছিল যুদ্ধ ও ঋণের পুনর্গঠন। কিন্তু এবার ডিজিটালাইজেশন ও বিনিয়োগের দ্রুত চলাচলের কারণে পরিবর্তনটি অনেক দ্রুত ঘটছে।
বিটকয়েন এই ডিজিটাল যুগের প্রতীক — সীমিত সরবরাহ ও অ্যালগরিদমিক নিয়ন্ত্রণ বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন আস্থা তৈরি করছে। ডেভিয়ার গ্রুপের বিশ্লেষক নাইজেল গ্রিন পূর্বাভাস দিয়েছেন, ২০২৫ সালের শেষে বিটকয়েন ২ লাখ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
স্বর্ণের নতুন ‘সুপারসাইকেল’
ইউবিএস জানিয়েছে, ২০২৬ সালের প্রথম দিকে সোনার দাম ৪,২০০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে স্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর অব্যাহত ক্রয়।
জুলিয়াস বেয়ার-এর কারস্টেন মেনকে বলেন, “স্বর্ণ আবার তার ঐতিহাসিক ভূমিকা ফিরে পেয়েছে — বাজেট শৃঙ্খলার অভাবের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিরক্ষক হিসেবে।”
নতুন বিশ্বাসের যুগ
স্বর্ণ ও বিটকয়েনের পারস্পরিক সম্পর্ক আজ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ‘বিশ্বাস’-এর নতুন সংজ্ঞা তৈরি করছে। দুটি সম্পদই রাষ্ট্রীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের প্রতিষেধক হয়ে উঠেছে। তাদের বিনিয়োগকারীরা ভিন্ন হলেও, উদ্দেশ্য এক — এমন এক ভবিষ্যৎ খোঁজা যেখানে মুদ্রার ওপর বিশ্বাস আর অনন্ত নয়, বরং সীমিত ও সুরক্ষিত।