প্রস্তাবনা
রাতের আঁধারে কানাডার নদীগুলো দিয়ে যে প্রাণীগুলো নিঃশব্দে সাঁতরে চলে যায়, তারা এখন এক আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের মূল চরিত্র — ইল মাছ বা এলভার। ইউরোপোলের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ইল পাচারের কালোবাজারের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৪.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। দাম আকাশছোঁয়া হওয়ায় এই বাণিজ্য যেমন অনেকের জীবিকা সৃষ্টি করেছে, তেমনি গড়ে তুলেছে এক ধ্বংসাত্মক অপরাধ নেটওয়ার্ক।
‘সোনার খনি’ থেকে সংকট
ইল মাছের চাহিদা বিশেষত এশিয়ায় দ্রুত বাড়ছে। এরা মূলত বন্যপ্রাণী; বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত তাদের প্রজনন প্রক্রিয়া পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করতে পারেননি। লার্ভা বা বাচ্চা ইল (যাদের বলা হয় ‘গ্লাস ইল’ বা ‘এলভার’ ) নদীর মোহনায় ধরা হয়, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এদের পাঠানো হয় এশিয়ার মাছ চাষের খামারে।
এক কিলোগ্রাম এলভারের (প্রায় ৩,৫০০টি বাচ্চা মাছ) দাম বৈধ বাজারে ৫,০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত পৌঁছায়। আর অবৈধ চোরাকারবারিদের কাছে দাম আরও চড়া। এই বিপুল মুনাফার কারণেই আইনি জালিয়াতি ও সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলেছে।
কানাডার এলভার সংকট
কানাডার ফিশারিজ অ্যান্ড ওশানস বিভাগ (DFO) ইল ধরার কোটা নির্ধারণ করে, কারণ এখনো পর্যন্ত এই প্রজাতি বন্দী অবস্থায় প্রজনন করতে সক্ষম নয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান দামের প্রলোভনে প্রতি বসন্তে অননুমোদিত মাছ শিকারিরা অনুমোদিত মাছধারীদের ছাপিয়ে যায়। হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনাও সাধারণ।
এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে DFO কয়েকবার মৌসুম আগেই বন্ধ করেছে এবং ২০২৪ সালে পুরো মৌসুমই বাতিল করেছে অতিরিক্ত শিকার ও সহিংসতার কারণে।
সংঘবদ্ধ অপরাধের ভূমিকা
সংগঠিত অপরাধচক্রের সম্পৃক্ততা এখন স্পষ্ট। অবৈধভাবে ধরা ইল বৈধ মাছের সঙ্গে মিশিয়ে রপ্তানি করা হচ্ছে, যা উৎস শনাক্তকরণকে কঠিন করে তুলছে। এদের বসবাসের ক্ষেত্র আমেরিকার উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকা এবং এমনকি গ্রিনল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত।
সালমনের মতো, ইল মাছ একই নদীতে ফিরে আসে না; তাদের সন্তানরা স্রোতের ভাঁজে ভাঁজে ভেসে অন্য উপকূলে চলে যায়। অর্থাৎ কানাডার নদী থেকে উৎপন্ন ইল একসময় হাইতি, ভেনেজুয়েলা বা যুক্তরাষ্ট্রের নদীতেও দেখা যেতে পারে।
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের চ্যালেঞ্জ
ক্যারিবিয়ান দেশগুলোতে অবৈধ মাছধরা রোধ করার মতো অবকাঠামো ও সম্পদ প্রায় নেই। সেখানে পাচারকারীরা তুলনামূলক কম দামে, চোরাই এলভার বিক্রি করে, যা বৈধ কানাডিয়ান মাছশিকারিদের প্রতিযোগিতার বাইরে ঠেলে দিচ্ছে।
কানাডা নিজেও এই বিশ্ববাজারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে — দেশীয় বৈধ ও অবৈধ এলভার রপ্তানির পাশাপাশি, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল থেকে আসা ৭০ শতাংশেরও বেশি ইল চালান কানাডা হয়ে এশিয়ায় পাঠানো হয়।
বিপন্ন ইউরোপীয় ইল ও বাজার প্রতারণা
গত সাত বছরে ভ্যাঙ্কুভার ও টরন্টোতে কর্তৃপক্ষ প্রায় ২০০ টন ইল মাংস জব্দ করেছে, যার বেশিরভাগই বিপন্ন ইউরোপীয় ইল — তবে তা মিথ্যা ঘোষণায় “আমেরিকান ইল” নামে আমদানি করা হয়েছিল। এই মাংসের অধিকাংশই সুসি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল, ফলে অনেক কানাডিয়ান অনিচ্ছাকৃতভাবে বিপন্ন প্রজাতি ভক্ষণ করেছেন।
ইতিহাসের সতর্কবার্তা
১৯৭০-এর দশকে এশিয়ার ইল অতিরিক্ত আহরণের ফলে বিপর্যস্ত হয়, এবং ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে ইউরোপীয় ইলের সংখ্যা ৯০ শতাংশ কমে যায়। এখন একই চাপ পড়ছে আমেরিকান ইলের ওপর, যা কানাডাসহ অন্যান্য দেশকে একই ভুল পুনরাবৃত্তির ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে।
বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণের সুযোগ
এই শরতে জাতিসংঘের Convention on International Trade in Endangered Species (CITES) সভায় সব ধরনের মিঠা পানির ইল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব উঠছে। উদ্দেশ্য কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং বৈজ্ঞানিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ, এবং প্রতিটি চালানের জন্য অনুমতিপত্র বাধ্যতামূলক করা, যাতে বৈধ ও টেকসই উৎস নিশ্চিত করা যায়।
বর্তমানে কেবল ইউরোপীয় ইল CITES তালিকাভুক্ত। কিন্তু বিভিন্ন প্রজাতির ইল এতটাই দেখতে একরকম যে সীমান্ত কর্মকর্তারা ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া (যার খরচ কনটেইনারপ্রতি ১০,০০০ ডলার পর্যন্ত) পার্থক্য করতে পারেন না।
সব প্রজাতিকে তালিকাভুক্ত করা হলে পাচারকারীদের ফাঁকফোকর বন্ধ হবে, সীমান্তে নজরদারি সহজ হবে এবং বৈশ্বিক ডেটা ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হবে। আমদানিকারক দেশগুলোকেও তদারকি বাড়াতে হবে, যা বাজারে একধরনের নিরাপত্তা আনবে।
বৈধ ব্যবসা ও টেকসই ভবিষ্যতের ভারসাম্য
দৃঢ় বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ কেবল পরিবেশ রক্ষাই করবে না, বরং কানাডার বৈধ ব্যবসায়ী ও আদিবাসী মৎস্যজীবীদের অন্যায্য প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করবে।
যদিও কিছু দেশ ইউরোপীয় ইলের বাইরেও এই সুরক্ষা বাড়ানোর প্রস্তাবে আপত্তি তুলেছে, তবু কানাডাসহ বিশ্বকে অবশ্যই এশিয়া ও ইউরোপের ধ্বংসের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সব প্রজাতির ইলকে বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে আনাই টেকসই ভবিষ্যতের একমাত্র পথ।
#ইল_পাচার #কানাডা #পরিবেশ_সংকট #CITES #বন্যপ্রাণী_অপরাধ #সারাক্ষণ_রিপোর্ট