প্রকৃতির রঙিন জগতে কিছু প্রাণী তাদের সৌন্দর্য ও শান্ত স্বভাবের জন্য আলাদা করে চোখে পড়ে। উত্তর আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে পাওয়া যায় এমন এক মনোমুগ্ধকর সরীসৃপ — রাফ গ্রিন স্নেক বা Opheodrys aestivus। গাছের পাতার মতো সবুজ দেহ, লম্বা ও চিকন গঠন, আর নিরীহ স্বভাব—সব মিলিয়ে এটি যেন প্রকৃতির তৈরি এক জীবন্ত রত্ন। অনেকেই ভুলবশত একে বিষধর মনে করেন, কিন্তু বাস্তবে এটি সম্পূর্ণ অবিষাক্ত (non venomous) এবং মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ।
পরিচিতি ও শ্রেণিবিন্যাস
বৈজ্ঞানিকভাবে রাফ গ্রিন স্নেকের নাম Opheodrys aestivus। এটি Colubridae পরিবারভুক্ত, যা বিশ্বের বৃহত্তম সাপের পরিবারগুলোর একটি। এই পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই বিষহীন এবং পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রাফ গ্রিন স্নেক সাধারণত বৃক্ষবাসী (arboreal) এবং ছোট পোকামাকড়ভোজী। এদের শরীর লম্বা, সরু ও অত্যন্ত নমনীয়—যা তাদের ডালপালা ও ঝোপের মধ্যে সহজে চলাচল করতে সাহায্য করে।
শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য
রাফ গ্রিন স্নেকের শরীরের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৬০ থেকে ১১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের গড় দৈর্ঘ্য প্রায় তিন ফুট।
- দেহের উপরের অংশ উজ্জ্বল সবুজ রঙের, যা গাছের পাতার সঙ্গে একেবারে মিশে যায়।
- পেটের অংশ বা তলদেশ হালকা হলুদাভ বা সাদা।
- চোখ বড় এবং গোল, যা দিনে শিকার ধরতে সাহায্য করে।
- নামের “রাফ” অংশটি এসেছে এর দেহের আঁশের টেক্সচার থেকে, যা হালকা খসখসে বা উঁচু-নিচু।
এই আঁশগুলোই একে “রাফ গ্রিন স্নেক” বলে আলাদা করেছে এর আত্মীয় “স্মুথ গ্রিন স্নেক” (Opheodrys vernalis) থেকে, যার দেহের আঁশ একদম মসৃণ।
আবাসস্থল
রাফ গ্রিন স্নেক প্রধানত উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল জুড়ে দেখা যায় — যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, ফ্লোরিডা, লুইজিয়ানা, আলাবামা, সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে শুরু করে ভার্জিনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।
এরা সাধারণত জলাশয়, নদীর ধারে, আর্দ্র জঙ্গল, ঝোপঝাড় বা বৃক্ষপূর্ণ এলাকায় বাস করে।
এরা বৃক্ষবাসী বলে দিনের বেশিরভাগ সময় ডালপালা বা পাতার মধ্যে কাটায়। রাতে প্রায়ই নিচে নেমে আসে বিশ্রাম বা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য।
খাদ্যাভ্যাস
এই সাপটি একেবারেই মাংসাশী কিন্তু ক্ষুদ্র প্রাণীভোজী।
তাদের খাদ্যতালিকায় থাকে:
- পোকামাকড় (grasshoppers, crickets)
- শুঁয়োপোকা
- মাকড়সা
- ছোট ব্যাঙ
- মাঝে মাঝে ছোট টিকটিকি
তারা খুব দ্রুত জিহ্বা বের করে বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে শিকার সনাক্ত করে এবং মুখ দিয়ে ধরে ফেলে। কোনো বিষ বা ফাঁদ ব্যবহার করে না—সম্পূর্ণভাবে তাদের গতিশীলতা ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল।
প্রজনন প্রক্রিয়া
রাফ গ্রিন স্নেকের প্রজনন ঘটে সাধারণত বসন্ত বা গ্রীষ্মকালে।
মিলনের পর স্ত্রী সাপ ৫–১২টি ডিম পাড়ে, সাধারণত শুকনো পাতা বা মাটির নিচে লুকিয়ে রাখে।
প্রায় ৪৫–৬০ দিন পর ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। জন্মের পরপরই তারা স্বাধীনভাবে চলাচল ও খাদ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম।
এই প্রজাতি বছরে একবার প্রজনন করে এবং বাচ্চারা দ্রুত পূর্ণবয়স্ক হয়, যা তাদের বেঁচে থাকার হার বাড়ায়।
আচরণ ও প্রকৃতি
রাফ গ্রিন স্নেক স্বভাবত অত্যন্ত শান্ত ও নিরীহ। মানুষ বা বড় প্রাণী দেখলে সঙ্গে সঙ্গে গাছের ডালে উঠে পড়ে বা পাতা-গাছের ভেতরে লুকিয়ে পড়ে।
তারা আক্রমণাত্মক নয়—কামড় দেওয়া বা প্রতিরোধ করার পরিবর্তে লুকিয়ে থাকা এদের প্রথম প্রতিক্রিয়া।
এরা দিনে সক্রিয় (diurnal) এবং রাতে বিশ্রাম নেয়।
তাদের চলাচল খুবই সুন্দর—ডালের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে, দোল খেতে খেতে এগিয়ে যায়। অনেকেই বলেন, এটি যেন পাতার মধ্যে এক টুকরো হালকা বাতাসের মতো নড়ে।
বিষ আছে কি?
একটি সাধারণ ভুল ধারণা হলো, সবুজ সাপ মানেই বিষধর। বাস্তবে রাফ গ্রিন স্নেক সম্পূর্ণ অবিষাক্ত (non-venomous)।
তারা মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। কামড়ালেও কোনো বিষক্রিয়া হয় না, বরং কামড়ই প্রায় দেয় না।
তাদের দেহে কোনো বিষগ্রন্থি নেই। এরা প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতির জন্য উপকারী সরীসৃপ, কারণ এরা ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আত্মরক্ষা ও শত্রু
যদিও এরা নিরীহ, তবুও এদের শত্রুর অভাব নেই।
পাখি, বড় সাপ, বিড়াল, শিয়াল, ব্যাঙ, এমনকি মানুষেরাও তাদের হুমকি তৈরি করে।
আত্মরক্ষার জন্য তারা সাধারণত নিচের উপায়গুলো অবলম্বন করে:
- ক্যামোফ্লাজ (Camouflage): তাদের সবুজ রঙ পাতার সঙ্গে এতটাই মিশে যায় যে সহজে চোখে পড়ে না।
- স্থির থাকা: বিপদের সময় তারা একেবারে নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়।
- দ্রুত পালানো: হঠাৎ বিপদ এলে গাছ থেকে ঝাঁপ দিয়ে বা দ্রুত সরে যায়।
এদের শান্ত স্বভাবই তাদের টিকে থাকার প্রধান কৌশল।
আবহাওয়া ও তাপমাত্রা
রাফ গ্রিন স্নেক গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া পছন্দ করে।
শীতকালে তারা সাধারণত হাইবারনেশন বা নিদ্রাস্থ অবস্থায় চলে যায়। এই সময় তারা মাটির গর্ত, পাথরের নিচে বা পরিত্যক্ত গাছের গহ্বরে আশ্রয় নেয়।
তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামলে তারা সক্রিয়তা কমিয়ে দেয়।