সোনার বাজারে নতুন রেকর্ড
মার্কিন সরকারের এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা অচলাবস্থা এবং ঋণসংক্রান্ত উদ্বেগের প্রভাব বিশ্ববাজারে স্পষ্ট। নিরাপদ বিনিয়োগের আশ্রয় হিসেবে সোনার দিকে বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক বেড়ে গেছে, ফলে দাম ছুঁয়েছে সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তর। একইসঙ্গে রুপার দামও দ্রুত বাড়ছে—একদিকে শিল্পখাতে চাহিদা, অন্যদিকে বিনিয়োগ সুরক্ষায় আগ্রহ—দুই কারণেই বাজারে প্রবল উত্থান।
রেকর্ড ছোঁয়া সোনার দাম
ভারতীয় বুলিয়ন ও জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (IBJA)–এর তথ্য অনুযায়ী, ৯ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) ২৪ ক্যারেট (৯৯৯ বিশুদ্ধতা) সোনার দাম দাঁড়ায় প্রতি ১০ গ্রামে ১,২২,৬২৯ রুপি। মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জে (MCX) ডিসেম্বর ফিউচার চুক্তিতে দাম ছিল ১,২০,৪৯৩ রুপি। পরের দিন সামান্য সংশোধনের পর শুক্রবার বাজার বন্ধ হয় ১,২১,৫২৫ রুপিতে।
এলকেপি সিকিউরিটিজের গবেষণা বিশ্লেষক জাতিন ত্রিবেদী বলেন, “মার্কিন সরকার বন্ধ থাকা ও ‘ডি-ডলারাইজেশন’ প্রবণতা সোনার প্রতি আস্থা বাড়াচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি কমাতে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে সোনা বেছে নিচ্ছেন।”
মার্কিন রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও প্রভাব
রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বাজেট নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে সরকার কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক তথ্যের ঘাটতিতে দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন না।
কমট্রেন্জ রিসার্চের সহ–প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও গ্নানাসেকার থিয়াগারাজন বলেন, “প্রতিসপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত অর্থনৈতিক তথ্য সুদের হার সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রাখে। এখন এসব তথ্য বন্ধ থাকায় সবাই অন্ধভাবে বিনিয়োগ করছে, অর্থনীতির বাস্তব চিত্র কারও জানা নেই।”
‘ডি-ডলারাইজেশন’ প্রবণতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কৌশল
কোয়ান্টাম এএমসি–এর প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা চিরাগ মেহতা জানান, “দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অনিশ্চয়তা ও ডলারের স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে বিশ্বের অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার নির্ভরতা কমিয়ে সোনাকে রিজার্ভ সম্পদ হিসেবে গ্রহণ করছে—এই প্রবণতা আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে।”
স্বর্ণভিত্তিক বিনিয়োগে প্রবাহ বৃদ্ধি
সোনার দামে তীব্র উত্থানের ফলে গোল্ড ইটিএফ (Exchange Traded Fund)–এ বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব মিউচুয়াল ফান্ডস ইন ইন্ডিয়া (AMFI)–এর তথ্যে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসে গোল্ড ইটিএফ–এর মোট সম্পদের পরিমাণ (AUM) বেড়ে দাঁড়ায় ৯০,১৩৫.৯৮ কোটি রুপি, যা আগস্টের ৭২,৪৯৫.৬০ কোটি রুপি থেকে প্রায় ২৪ শতাংশ বেশি।
রুপার দামে সর্বোচ্চ উত্থান
আইবিজেএ–এর তথ্যমতে, ১০ অক্টোবর (শুক্রবার) ৯৯৯ বিশুদ্ধতার রুপার দাম ছুঁয়েছে প্রতি কেজিতে ১,৬৪,৫০০ রুপি—যা সর্বকালের সর্বোচ্চ। বিশেষজ্ঞদের মতে, রুপার দামের উত্থান সোনার গতির সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও শিল্পখাতের চাহিদাও বড় ভূমিকা রাখছে।
থিয়াগারাজন বলেন, “রুপা বৈদ্যুতিক যান (EV) ও অন্যান্য শিল্পে অপরিহার্য ধাতু। এর দাম বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়ে। তাই খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেক কোম্পানি এখন থেকেই রুপা কেনা শুরু করেছে।”
এছাড়া, সিলভার ইটিএফ–এ বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে এর নিট সম্পদ ৩৬,৪৬০.৯৪ কোটি রুপিতে পৌঁছেছে, যা আগস্টের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।
শেয়ারবাজার স্থবির, বিকল্প হিসেবে রুপা
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শেয়ারবাজার স্থবির থাকায় বিনিয়োগকারীরা বিকল্প নিরাপদ সম্পদ হিসেবে রুপার দিকে ঝুঁকছেন। ফলে এটি এখন একমাত্র ধাতু, যার দাম ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে।
মূল্য সংশোধনের সম্ভাবনা
বিশ্লেষকদের ধারণা, স্বল্পমেয়াদে মুনাফা তোলার কারণে কিছুটা মূল্য সংশোধন হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে সোনা ও রুপার প্রতি বাজারের আস্থা অটুট থাকবে।
চিরাগ মেহতা বলেন, “সোনা প্রথমবারের মতো ৪,০০০ ডলার সীমা পার করেছে, কিন্তু ৪,০৫০ ডলারে শক্ত প্রতিরোধ দেখা দিয়েছে। ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি কমে যাওয়ায় দামে কিছুটা চাপ এসেছে, কিন্তু মৌলিক ভিত্তি এখনও শক্ত। অতীতে যেমন ১৯৭০ ও ২০০০-এর দশকের বুল মার্কেটে দেখা গিয়েছিল, তেমন সাময়িক সংশোধন বা স্থিতি পর্যায় স্বাভাবিক।”
বিনিয়োগকারীদের করণীয়
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান দামে ধীরে ধীরে সোনা ও রুপা পোর্টফোলিওতে যুক্ত করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বাজারে স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষা দিতে সক্ষম।