১১:২৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
দ্য হান্টিং ওয়াইভস’ নিয়ে এসএনএলের ব্যঙ্গ—অব্রি প্লাজার চমক জিওইঞ্জিনিয়ারিং আলোচনায় কেন্দ্রস্থ—কীভাবে গবেষণা, কতটা শাসন ১৮৪ দিনের ওসাকা এক্সপো শেষ—২৮ মিলিয়ন দর্শনার্থীর পর স্থায়ী উত্তরাধিকার কী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৩৫) একজন অভিনেতা, কবি ও মানুষ: শৈশব থেকে শিল্পের শীর্ষে শাহেদ শরীফ খানের জীবনগাথা চিড়িয়াখানার মৃত্যু উপত্যকা—অবহেলা, দুর্নীতি ও প্রাণহীন প্রশাসন -তৃতীয় পর্ব নারায়ণগঞ্জে কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ ৭ শ্রমিক স্বচ্ছ জল, নীল আকাশ, পাহাড়ের কোলে বয়ে চলা এক জাদুকরী স্বর্গনদী—জাদুকাটা নদী স্বর্গের ছায়া নেমে এসেছে সুনামগঞ্জে সাভারে মানবপাচার চক্রের আট সদস্য গ্রেপ্তার ইউরোপে বিমানবন্দর–গ্রিডের ওপর ড্রোন অনুপ্রবেশ—প্রতিরোধে সেন্সর, জ্যামিং, নতুন বিধি

চিড়িয়াখানার মৃত্যু উপত্যকা—অবহেলা, দুর্নীতি ও প্রাণহীন প্রশাসন -তৃতীয় পর্ব

একটি শহরের চিড়িয়াখানা, যেখানে প্রতিটি খাঁচা একেকটি কবর।
প্রাণীগুলো মারা যাচ্ছে ধীরে, নীরবে, আর প্রশাসন সেটিকে বলছে “দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা”।
এই নীরবতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে করাচি চিড়িয়াখানার আসল চেহারা—
এক মৃত্যু উপত্যকা, যেখানে বেঁচে থাকা মানে কেবল পরবর্তী মৃত্যুর অপেক্ষা।


মৃত্যুর পরিসংখ্যান: সংখ্যার পেছনে হারানো জীবন

করাচি চিড়িয়াখানার অফিসিয়াল রেকর্ড অনুযায়ী, গত দুই বছরে ৪০টিরও বেশি প্রাণী মৃত্যুবরণ করেছে।
তাদের মধ্যে ছিল আফ্রিকান সিংহ, হায়েনা, উটপাখি, হরিণ, ময়ূর, এমনকি একটি হাতিও।
প্রতিটি মৃত্যুর পর প্রশাসনের বক্তব্য ছিল এক—
“প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু ঘটেছে।”

কিন্তু প্রাণী-চিকিৎসকদের ভাষায়, এদের বেশিরভাগই মারা গেছে অপুষ্টি, নোংরা পরিবেশ, বা দীর্ঘদিনের মানসিক যন্ত্রণায়।
খাঁচায় ময়লা জমে থাকে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ; পানির ট্যাংকে শ্যাওলা, খাদ্য অনিয়মিত, ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ।

যে প্রাণীগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যত্নকারীদের ওপর, তাদের অনেকেই কখনও প্রশিক্ষিত নয়।
কেউ সরকারি বেতন নিচ্ছে, কেউ চুক্তিভিত্তিক কর্মী—অর্থাৎ, যতদিন প্রাণী টিকে আছে, ততদিনই কাজের নিশ্চয়তা।

মৃত প্রাণীর খাঁচা, জীবন্ত দর্শক

একদিন সকালে প্রবেশদ্বারের কাছেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম—
একটি খাঁচায় মৃত হরিণ পড়ে আছে, চোখ খোলা, শরীর শক্ত হয়ে গেছে।
খাঁচার বাইরে দাঁড়িয়ে মানুষ ছবি তুলছে, কেউ হাসছে, কেউ বলছে—
“ওহ! মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে।”

প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কেন সরানো হয়নি?”

সে উদাস ভঙ্গিতে বলল,
“কাল রাতেই মরে গেছে। অফিসে জানিয়েছি। এখনো নির্দেশ আসেনি।”

এই “নির্দেশের অপেক্ষা”ই যেন করাচি চিড়িয়াখানার প্রতিটি জীবনের ভাগ্যনির্ধারক বাক্য।
মৃত প্রাণী পড়ে থাকে, জীবিত প্রাণী দেখে—আর দর্শকরা বিনোদিত হয়।


প্রশাসনের মুখোশ: দায়িত্বের নামের নাটক

চিড়িয়াখানার পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বোঝা গেল, তাদের কাছে প্রাণী নয়, “সংখ্যা”ই আসল বিষয়।
প্রাণী মরে গেলে রিপোর্ট তৈরি হয়, ফাইল যায় ঊর্ধ্বতন দপ্তরে, নতুন প্রাণী আনার আবেদন পাঠানো হয়—
চক্র সম্পূর্ণ।

তিনি গর্ব করে বললেন,
“আমরা শহরের শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা রাখছি।”

আমি ভাবলাম—কোন শিশু? সেই শিশু, যে প্রাণীর চোখে বেঁচে থাকা দেখার কথা, কিন্তু এখন দেখে মৃত্যুকে খেলনা ভেবে?
চিড়িয়াখানার এই বিনোদন আসলে শেখাচ্ছে—“মৃত্যুও এক প্রদর্শন।”

দুর্নীতির শিকড়: খাদ্য থেকে চিকিৎসা পর্যন্ত

খাদ্য সরবরাহের বরাদ্দ আছে, কিন্তু তা পৌঁছায় না প্রাণীর কাছে।
সরবরাহকারীরা কম খাবার দেয়, কর্মচারীরা ভাগ নেয়, আর প্রাণীরা পায় অবশিষ্টাংশ।
প্রাণী-চিকিৎসা বাজেটও একইভাবে অদৃশ্য।
বছরের শেষে রিপোর্টে দেখা যায় “চিকিৎসা সম্পন্ন”—কিন্তু কোনো নথিতে নেই কোন প্রাণীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল।

একজন প্রাক্তন কর্মচারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থেকে বললেন—
“এখানে প্রাণীর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিল, টেন্ডার, আর কমিশন।”
তার কণ্ঠে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু তাতে অভিযোগের আগুনও ছিল।


চিড়িয়াখানার ভাষা: মৃত্যু মানে ‘রিপোর্ট’

একটি সিংহের মৃত্যু মানে কাগজে একটি রিপোর্ট, একটি ফাইল, একটি মিটিং।
কিন্তু তার জীবনের গল্প কেউ লেখে না।
তার গর্জন বন্ধ হয়ে গেলে কেবল সংখ্যা বাড়ে।

করাচি চিড়িয়াখানার ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল,
প্রতিটি খাঁচা যেন একটি সরকারি দপ্তর—
যেখানে প্রাণী নয়, নিয়মই শাসক।

এখানে “জীবন” শব্দটির মানে কেবল উপস্থিতি,
আর “মৃত্যু” মানে প্রশাসনিক ফাইলের একটি নতুন লাইন।

মৃত্যুর গন্ধ, উদাসীনতার নীরবতা

রানো নামের সেই বিষণ্ন ভালুকের খাঁচার পাশ দিয়ে যখন হাঁটছিলাম,
বাতাসে পচা গন্ধ ভেসে আসছিল—যে গন্ধ মৃত্যু ও অবহেলার একসঙ্গে মিশ্রণ।
প্রহরীরা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, দর্শকরা নাক চেপে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে।
কেউ থামছে না।

এই নীরবতা আসলে মানুষের সবচেয়ে বড় অপরাধ।
যেখানে মৃত্যু চোখের সামনে, কিন্তু কেউ তা দেখতে চায় না।


এক শহরের লজ্জা, এক জাতির প্রতিফলন

করাচি চিড়িয়াখানার দেয়ালের ভেতর শুধু প্রাণীর মৃত্যু নয়, মানুষের বিবেকের মৃত্যুও ঘটছে।
এটি শুধু একটি শহরের ব্যর্থতা নয়—এটি এক জাতির নৈতিক প্রতিফলন।
যে জাতি তার দুর্বলদের রক্ষা করতে পারে না, সে নিজের শক্তিতেও ভরসা রাখতে পারে না।

এই চিড়িয়াখানা তাই এক নিঃশব্দ বার্তা—
সভ্যতার নামের আড়ালে আমরা আসলে কী হয়ে উঠেছি?

#চিড়িয়াখানা #করাচি #প্রাণী_অধিকার #সারাক্ষণ_রিপোর্ট #KarachiZoo #AnimalRights #প্রাণীমৃত্যু #দুর্নীতি #মানবিকতা #InvestigativeStory #Feature

জনপ্রিয় সংবাদ

দ্য হান্টিং ওয়াইভস’ নিয়ে এসএনএলের ব্যঙ্গ—অব্রি প্লাজার চমক

চিড়িয়াখানার মৃত্যু উপত্যকা—অবহেলা, দুর্নীতি ও প্রাণহীন প্রশাসন -তৃতীয় পর্ব

০৮:০০:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫

একটি শহরের চিড়িয়াখানা, যেখানে প্রতিটি খাঁচা একেকটি কবর।
প্রাণীগুলো মারা যাচ্ছে ধীরে, নীরবে, আর প্রশাসন সেটিকে বলছে “দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা”।
এই নীরবতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে করাচি চিড়িয়াখানার আসল চেহারা—
এক মৃত্যু উপত্যকা, যেখানে বেঁচে থাকা মানে কেবল পরবর্তী মৃত্যুর অপেক্ষা।


মৃত্যুর পরিসংখ্যান: সংখ্যার পেছনে হারানো জীবন

করাচি চিড়িয়াখানার অফিসিয়াল রেকর্ড অনুযায়ী, গত দুই বছরে ৪০টিরও বেশি প্রাণী মৃত্যুবরণ করেছে।
তাদের মধ্যে ছিল আফ্রিকান সিংহ, হায়েনা, উটপাখি, হরিণ, ময়ূর, এমনকি একটি হাতিও।
প্রতিটি মৃত্যুর পর প্রশাসনের বক্তব্য ছিল এক—
“প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু ঘটেছে।”

কিন্তু প্রাণী-চিকিৎসকদের ভাষায়, এদের বেশিরভাগই মারা গেছে অপুষ্টি, নোংরা পরিবেশ, বা দীর্ঘদিনের মানসিক যন্ত্রণায়।
খাঁচায় ময়লা জমে থাকে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ; পানির ট্যাংকে শ্যাওলা, খাদ্য অনিয়মিত, ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ।

যে প্রাণীগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল যত্নকারীদের ওপর, তাদের অনেকেই কখনও প্রশিক্ষিত নয়।
কেউ সরকারি বেতন নিচ্ছে, কেউ চুক্তিভিত্তিক কর্মী—অর্থাৎ, যতদিন প্রাণী টিকে আছে, ততদিনই কাজের নিশ্চয়তা।

মৃত প্রাণীর খাঁচা, জীবন্ত দর্শক

একদিন সকালে প্রবেশদ্বারের কাছেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম—
একটি খাঁচায় মৃত হরিণ পড়ে আছে, চোখ খোলা, শরীর শক্ত হয়ে গেছে।
খাঁচার বাইরে দাঁড়িয়ে মানুষ ছবি তুলছে, কেউ হাসছে, কেউ বলছে—
“ওহ! মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে।”

প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কেন সরানো হয়নি?”

সে উদাস ভঙ্গিতে বলল,
“কাল রাতেই মরে গেছে। অফিসে জানিয়েছি। এখনো নির্দেশ আসেনি।”

এই “নির্দেশের অপেক্ষা”ই যেন করাচি চিড়িয়াখানার প্রতিটি জীবনের ভাগ্যনির্ধারক বাক্য।
মৃত প্রাণী পড়ে থাকে, জীবিত প্রাণী দেখে—আর দর্শকরা বিনোদিত হয়।


প্রশাসনের মুখোশ: দায়িত্বের নামের নাটক

চিড়িয়াখানার পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বোঝা গেল, তাদের কাছে প্রাণী নয়, “সংখ্যা”ই আসল বিষয়।
প্রাণী মরে গেলে রিপোর্ট তৈরি হয়, ফাইল যায় ঊর্ধ্বতন দপ্তরে, নতুন প্রাণী আনার আবেদন পাঠানো হয়—
চক্র সম্পূর্ণ।

তিনি গর্ব করে বললেন,
“আমরা শহরের শিশুদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা রাখছি।”

আমি ভাবলাম—কোন শিশু? সেই শিশু, যে প্রাণীর চোখে বেঁচে থাকা দেখার কথা, কিন্তু এখন দেখে মৃত্যুকে খেলনা ভেবে?
চিড়িয়াখানার এই বিনোদন আসলে শেখাচ্ছে—“মৃত্যুও এক প্রদর্শন।”

দুর্নীতির শিকড়: খাদ্য থেকে চিকিৎসা পর্যন্ত

খাদ্য সরবরাহের বরাদ্দ আছে, কিন্তু তা পৌঁছায় না প্রাণীর কাছে।
সরবরাহকারীরা কম খাবার দেয়, কর্মচারীরা ভাগ নেয়, আর প্রাণীরা পায় অবশিষ্টাংশ।
প্রাণী-চিকিৎসা বাজেটও একইভাবে অদৃশ্য।
বছরের শেষে রিপোর্টে দেখা যায় “চিকিৎসা সম্পন্ন”—কিন্তু কোনো নথিতে নেই কোন প্রাণীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল।

একজন প্রাক্তন কর্মচারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থেকে বললেন—
“এখানে প্রাণীর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিল, টেন্ডার, আর কমিশন।”
তার কণ্ঠে ক্লান্তি ছিল, কিন্তু তাতে অভিযোগের আগুনও ছিল।


চিড়িয়াখানার ভাষা: মৃত্যু মানে ‘রিপোর্ট’

একটি সিংহের মৃত্যু মানে কাগজে একটি রিপোর্ট, একটি ফাইল, একটি মিটিং।
কিন্তু তার জীবনের গল্প কেউ লেখে না।
তার গর্জন বন্ধ হয়ে গেলে কেবল সংখ্যা বাড়ে।

করাচি চিড়িয়াখানার ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল,
প্রতিটি খাঁচা যেন একটি সরকারি দপ্তর—
যেখানে প্রাণী নয়, নিয়মই শাসক।

এখানে “জীবন” শব্দটির মানে কেবল উপস্থিতি,
আর “মৃত্যু” মানে প্রশাসনিক ফাইলের একটি নতুন লাইন।

মৃত্যুর গন্ধ, উদাসীনতার নীরবতা

রানো নামের সেই বিষণ্ন ভালুকের খাঁচার পাশ দিয়ে যখন হাঁটছিলাম,
বাতাসে পচা গন্ধ ভেসে আসছিল—যে গন্ধ মৃত্যু ও অবহেলার একসঙ্গে মিশ্রণ।
প্রহরীরা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, দর্শকরা নাক চেপে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে।
কেউ থামছে না।

এই নীরবতা আসলে মানুষের সবচেয়ে বড় অপরাধ।
যেখানে মৃত্যু চোখের সামনে, কিন্তু কেউ তা দেখতে চায় না।


এক শহরের লজ্জা, এক জাতির প্রতিফলন

করাচি চিড়িয়াখানার দেয়ালের ভেতর শুধু প্রাণীর মৃত্যু নয়, মানুষের বিবেকের মৃত্যুও ঘটছে।
এটি শুধু একটি শহরের ব্যর্থতা নয়—এটি এক জাতির নৈতিক প্রতিফলন।
যে জাতি তার দুর্বলদের রক্ষা করতে পারে না, সে নিজের শক্তিতেও ভরসা রাখতে পারে না।

এই চিড়িয়াখানা তাই এক নিঃশব্দ বার্তা—
সভ্যতার নামের আড়ালে আমরা আসলে কী হয়ে উঠেছি?

#চিড়িয়াখানা #করাচি #প্রাণী_অধিকার #সারাক্ষণ_রিপোর্ট #KarachiZoo #AnimalRights #প্রাণীমৃত্যু #দুর্নীতি #মানবিকতা #InvestigativeStory #Feature