রাতভর সংঘর্ষে তীব্র উত্তেজনা
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে রাতভর তীব্র সংঘর্ষে অন্তত ৮০ জন নিহত হয়েছেন বলে দুই পক্ষের দাবি। রবিবার উভয় দেশই বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এটি ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ সীমান্ত সংঘর্ষ বলে মনে করা হচ্ছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তাদের ২৩ জন সৈন্য নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, আফগানিস্তানের তালেবান সরকার দাবি করেছে, তাদের নয়জন যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন। তবে উভয় পক্ষই একে অপরের ওপর আরও বেশি হতাহতের অভিযোগ তুলেছে—পাকিস্তানের দাবি, তারা ২০০ জনের বেশি আফগান তালেবান ও তাদের মিত্র যোদ্ধাকে হত্যা করেছে; অন্যদিকে কাবুল বলছে, তাদের হাতে নিহত হয়েছে ৫৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য। এসব তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি রয়টার্স।
পাকিস্তানের বিমান হামলা থেকেই সংঘর্ষের সূত্রপাত
সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের বিমান হামলার পর। ইসলামাবাদ থেকে পাঠানো যুদ্ধবিমান কাবুল ও পূর্ব আফগানিস্তানের একটি বাজারে হামলা চালায় বলে পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও তালেবান উভয়েই জানিয়েছেন। তবে পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিমান হামলাটি স্বীকার করেনি।
এর জবাবে শনিবার রাতে আফগান সেনারা সীমান্তের পাকিস্তানি পোস্টে গুলি চালায়। পাকিস্তান তখন পাল্টা ভারী কামান ও বন্দুক হামলা চালায় বলে জানা গেছে। উভয় দেশই একে অপরের সীমান্ত পোস্ট ধ্বংসের দাবি করেছে। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা এমন ভিডিওও প্রকাশ করেছেন, যাতে দেখা যায়, বলে দাবি করা হচ্ছে, আফগান পোস্টগুলোতে তাদের কামানের গোলা পড়ছে।
চামান সীমান্তে আতঙ্ক, লোকজনের দেশত্যাগ
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চামান সীমান্ত এলাকায় ভয়াবহ গোলাগুলির পর আফগান নাগরিকরা দেশ ছাড়ছেন। পাকিস্তান-আফগান সীমান্তের বেলুচিস্তান প্রদেশের এই পথটি দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে ব্যস্ত বাণিজ্যিক রুটগুলোর একটি। রবিবার সকাল নাগাদ গুলিবিনিময় থেমে এলেও, কুররম এলাকায় ছিটেফোঁটা গোলাগুলি চলছিল বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, তাদের সামরিক অভিযান মধ্যরাতের পরই শেষ হয়েছে। কাবুল পরে জানায়, কাতার ও সৌদি আরবের অনুরোধে তারা আক্রমণ বন্ধ করে। এই দুই উপসাগরীয় দেশ সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তালেবানের অবস্থান: ‘আমাদের ভূমিতে কোনো হুমকি নেই’
আফগান সরকারের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ রবিবার বলেন, “আফগানিস্তানের কোনো অংশেই এখন কোনো হুমকি নেই। ইসলামিক এমিরেট ও আফগান জনগণ তাদের ভূমি রক্ষায় অটল রয়েছে।” তিনি আরও জানান, কিছু এলাকায় এখনও বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ চলছে।
সীমান্তপথ বন্ধ, দুই দেশের বাণিজ্য স্থবির
রবিবার পাকিস্তানি কর্মকর্তারা জানান, দুই দেশের মধ্যে ২ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিতর্কিত ডুরান্ড রেখা বরাবর সব সীমান্তপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান দুটি রুট—তোর্খাম ও চামান—সহ অন্তত তিনটি ছোট ক্রসিং (খারলাচি, আঙ্গুরআড্ডা ও গুলাম খান) বন্ধ রয়েছে।
ডুরান্ড লাইনটি ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্ধারিত হয় এবং তখন থেকেই এটি দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধের অন্যতম মূল ইস্যু।
ভারত সফরে তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতি
সংঘর্ষের সময়ই ভারত সফর করেন আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুতাক্কি। তার এই সফরের পর নয়াদিল্লি ঘোষণা দেয়, তারা আফগানিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করবে। পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে তালেবানের এই ঘনিষ্ঠতা ইসলামাবাদে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের এই সংঘর্ষ শুধু সীমান্ত উত্তেজনা নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাতার ও সৌদি আরবের মধ্যস্থতার পর আপাতত গুলি থেমে গেলেও, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অবিশ্বাস ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যে সহজে শেষ হচ্ছে না, সেটি আবারও স্পষ্ট হলো।