তালেবান দলের নারী সাংবাদিক নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত
নয়াদিল্লিতে আফগান দূতাবাসে শুক্রবার তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুত্তাক্কির সংবাদ সম্মেলনে নারী সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। সূত্র জানায়, এই সিদ্ধান্ত নেয় তালেবান প্রতিনিধিদল নিজেদের সিদ্ধান্তে। দূতাবাসের বর্তমান আফগান কর্মীরা এই বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও তা উপেক্ষিত হয়।
বিতর্কের কেন্দ্র: নয়াদিল্লির আফগান দূতাবাস
চানাক্যপুরীর শান্তিপথে অবস্থিত আফগান দূতাবাস বর্তমানে আগের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র আফগানিস্তানের অধীন কর্মচারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। তাদের সংখ্যা প্রায় ২৩ জন, যার মধ্যে ছয়জন আফগান। তারা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সরকারের প্রতিনিধি, যিনি ২০২১ সালে তালেবান দখলের সময় দেশ ত্যাগ করেছিলেন।
তালেবান মন্ত্রী মুত্তাক্কির সফরের আগে এই কর্মীরা চার্জ দ্য’ অ্যাফেয়ার্স সাঈদ মোহাম্মদ ইব্রাহিম খিলকে অনুরোধ করেন যেন দূতাবাসে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত না হয়। তাদের আশঙ্কা ছিল, তালেবান এই সুযোগে দূতাবাসকে ‘ইমিরেট’ বলে ঘোষণা করে প্রজাতন্ত্রের পতাকা নামিয়ে নিজেদের পতাকা তুলবে এবং নারী সাংবাদিকদের বাদ দেবে। এজন্য তারা বিকল্প হিসেবে একটি হোটেল প্রস্তাব করেছিল, যেখানে তালেবান প্রতিনিধি দল অবস্থান করছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘নিষ্ক্রিয় ভূমিকা’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (MEA) জানায়, তারা এই সংবাদ সম্মেলনে কোনোভাবেই জড়িত ছিল না। যদিও সরকারি সূত্রে জানা যায়, তারা দূতাবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে “সহযোগিতা করতে” বলেছিল, যাতে তালেবান সেখানে ব্রিফিং করতে পারে।
যেহেতু অনুষ্ঠানটি দূতাবাসের ভেতরে অনুষ্ঠিত হয় — যা ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনৈতিকভাবে সুরক্ষিত এলাকা — তালেবান সেই আইনি সুরক্ষার সুযোগ নিয়ে নারী সাংবাদিকদের বাদ দেয়। শুরুতে ১২ জন সাংবাদিককে অনুমতি দেওয়া হয়, পরে তালিকা বাড়িয়ে ১৬ জন করা হয় — সবাই পুরুষ।
নারী সাংবাদিক ও আফগান কর্মীদের ক্ষোভ
দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা জানি তালেবান আফগানিস্তানে কীভাবে নারীদের সঙ্গে আচরণ করে। আমাদের পরিবার ও আত্মীয়রা চার বছর ধরে কষ্ট পাচ্ছেন। আজ তারা আফগানিস্তানের নামকেই কলঙ্কিত করল।”
অন্যদিকে, বিদ্রূপজনকভাবে, এই দূতাবাস এখনো তালেবান সরকারের স্বীকৃতি পায়নি। ভারত সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকার করেনি, যদিও মুত্তাক্কির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকের পর তালেবান কূটনীতিকদের দিল্লিতে কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
নারী সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ার ঘটনায় বিরোধী দল ও সংবাদমাধ্যম সংগঠনগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, “এমন বৈষম্য মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশকে দেখালেন, তিনি নারীদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো সাহস রাখেন না।”
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বলেন, “যদি নারীর অধিকার কেবল নির্বাচনের সময়ের প্রচারণা না হয়, তবে দেশের মাটিতে এমন অপমান কীভাবে ঘটতে পারে?” ভারতীয় উইমেনস প্রেস কর্পস এই সিদ্ধান্তকে “গভীরভাবে বৈষম্যমূলক” বলে অভিহিত করে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে, ভবিষ্যতে এমন লিঙ্গভিত্তিক বর্জন যেন না ঘটে।
কূটনীতিকদের প্রতিক্রিয়া
সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিবেক কাজ্জু বলেন, “এটি অত্যন্ত পশ্চাদমুখী সিদ্ধান্ত। আমি এর তীব্র বিরোধিতা করছি, যদিও বুঝতে পারছি বর্তমান আঞ্চলিক কূটনৈতিক বাস্তবতায় ভারত কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়।”
আরেক সাবেক রাষ্ট্রদূত গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “এটি দেখায় যে কেবল নিরাপত্তাভিত্তিক কূটনীতি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, যখন মূল্যবোধ — বিশেষত লিঙ্গসমতার ধারণা — উপেক্ষিত হয়।”
দূতাবাসের একমাত্র নারী কর্মীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
সূত্র জানায়, দূতাবাসের একমাত্র আফগান নারী কর্মী শুক্রবার দুপুরে, সংবাদ সম্মেলনের দেড় ঘণ্টা আগে, নিজের কর্মস্থল ছেড়ে চলে যান। তিনি নিজেকে নিরাপদ মনে করছিলেন না। তার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।
দারুল উলুম দারশনে নতুন বিতর্ক
শনিবার মুত্তাক্কি উত্তরপ্রদেশের দারুল উলুম দেওবন্দ সফরে গেলে সেখানে নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলনও বাতিল করা হয়। ঘটনার কিছুক্ষণ আগে এক আলেম এক নারী ফটোসাংবাদিককে প্রশ্ন করেন, “আপনি কীভাবে এখানে ঢুকলেন?” এরপর মুত্তাক্কির দল ঘোষণা করে, মন্ত্রী কেবল উপাচার্য ও অন্যান্য আলেমদের সঙ্গে বন্ধ দরজার বৈঠক করবেন।
মুত্তাক্কি বলেন, “আমি ভারতের সরকারের সঙ্গে ও দেওবন্দের আলেমদের সঙ্গে কথা বলেছি। আশা করি এই সম্পর্ক ভবিষ্যতেও এমনই সৌহার্দ্যপূর্ণ থাকবে।”
এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে — তালেবান নারী অধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে তাদের পুরনো মনোভাবই বহন করছে। ভারত সরকারের নীরবতা ও তালেবানকে কূটনৈতিক সুবিধা দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, বিশেষত যখন এই ঘটনাগুলো ভারতের মাটিতেই ঘটছে।
#তালেবান_ভারত, নারী_সাংবাদিক, আফগান_দূতাবাস, আমির_খান_মুত্তাক্কি, দিল্লি_বিতর্ক, নারীর_অধিকার, সারাক্ষণ_রিপোর্ট