বিহার নির্বাচনের সময়সূচি ও জাতীয় প্রভাব
ভারতের রাজনীতির তুলনামূলক স্থিতিশীল প্রেক্ষাপটে বিহার এখন ব্যতিক্রম। নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে, দুই দফায় ভোট হবে—৬ ও ১১ নভেম্বর, আর গণনা হবে ১৪ নভেম্বর, শিশু দিবসে। এই নির্বাচনের ফল শুধু বিহারেই নয়, ২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, তামিলনাড়ু, কেরালা এবং পরের বছরের উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট ও পাঞ্জাব নির্বাচনের দিকও নির্ধারণ করবে।
বিহার থেকে লোকসভায় ৪০ জন সাংসদ নির্বাচিত হন, যা কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় ভূমিকা রাখে। বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে তাই বিহারের ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, কাশ্মীরের পাহালগাম হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও ‘অপারেশন সিন্ধূর’-এর কারণে যে রাজনৈতিক ধাক্কা বিজেপি পেয়েছিল, তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারল কি না—তাও নির্ধারিত হবে এই নির্বাচনে।
নতুন মুখ প্রশান্ত কিশোর ও রাজনীতির রূপান্তর
১৪ নভেম্বরের ভোটগণনা একদিকে যেমন বিজেপি-জেডিইউ জোটের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, তেমনই আলোচনায় থাকবে ‘পিকে ফ্যাক্টর’। ভোটকৌশলী থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা জন সুরাজ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্ত কিশোরের উপস্থিতি কি প্রচলিত জাতভিত্তিক রাজনীতির বাইরে নতুন এক রাজনৈতিক চিন্তাধারার সূচনা করতে পারবে—এখন সেটিই দেখার বিষয়।
বিহার বরাবরই ভারতের রাজনৈতিক পরীক্ষাগার হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৭ সালের জরুরি অবস্থার পর জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে এখান থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর পতন শুরু হয় এবং কংগ্রেস-বহির্ভূত প্রথম কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হয়। একইভাবে, অত্যন্ত পশ্চাৎপদ শ্রেণির (EBC) রাজনৈতিক উত্থানও শুরু হয় এই রাজ্য থেকেই, যার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার।
নারীদের জন্য ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’
বর্তমান নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত উদ্যোগ হলো মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা (MMRY)। ২০১০ সাল থেকে বিহারের টানা তিনটি নির্বাচনে পুরুষদের তুলনায় বেশি নারী ভোট দিয়েছেন, যা প্রমাণ করে ‘মহিলা ভোটব্যাংক’-এর শক্তি।
এই প্রকল্পে প্রতিটি যোগ্য পরিবারের এক নারী সদস্যকে ১০,০০০ রুপি প্রাথমিক সহায়তা দেওয়া হবে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করার জন্য, এবং সফল উদ্যোগের ক্ষেত্রে আরও ২ লাখ রুপি পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি ৭৫ লাখ নারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রথম কিস্তি স্থানান্তর করেছেন এই প্রকল্পের উদ্বোধনের সময়।
নীতীশ কুমার এই প্রকল্পের মাধ্যমে মধ্যপ্রদেশের ‘লাডলি বেহেন যোজনা’ ও মহারাষ্ট্রের ‘লাডকি বহিন যোজনা’-কে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন—যেখানে নারীদের হাতে আরও বেশি টাকার ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে। এই দুই প্রকল্পই যথাক্রমে ২০২৩ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ও মহাযুতি জোটের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মহিলাদের ভোটের প্রভাব ও রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব
মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের নারীদের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, আর্থিক সহায়তা প্রকল্পগুলো ভোটে সরাসরি প্রভাব ফেলে। অরঙ্গাবাদ জেলার এক গ্রামীণ ভোটার বলেছিলেন, “আমাদের স্বামীরা যাকে খুশি ভোট দিক, কিন্তু আমরা দেব ‘মামা’র জন্য—কারণ উনিই আমাদের হাতে টাকা দিয়েছেন।”
নীতীশ কুমার খুব তাড়াতাড়িই বুঝেছিলেন, নারী সমাজ এখন ভারতের সবচেয়ে ‘আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ’ শ্রেণি। ২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসার পর তিনি মেয়েদের জন্য সাইকেল ও ইউনিফর্ম বিতরণ প্রকল্প চালু করেন, যা স্কুলে ভর্তি ও উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়।
২০১৬ সালে নারীদের অনুরোধে রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ করেন তিনি—যদিও এর ফলে বেআইনি মদের ব্যবসা, রাজস্ব হ্রাস ও পুরুষদের গ্রেপ্তারের মতো সমস্যা দেখা দেয়। তবুও নারীদের সমর্থন তিনি হারাননি। স্থানীয় সরকারে ৫০ শতাংশ, সরকারি চাকরিতে ৩৫ শতাংশ ও পুলিশে ৩৫ শতাংশ নারী সংরক্ষণের নীতিও তাঁকে নারীদের চোখে জনপ্রিয় নেতা করে তুলেছে।
নারীদের নতুন আকাঙ্ক্ষা
গ্রামীণ এলাকায় সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জন তরুণীর মধ্যে ৭ জন পুলিশে চাকরি করতে চায়। তাঁদের মতে, পুলিশের চাকরি মানে ক্ষমতা ও স্বাধীনতা। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বী দল রাজদ (আরজেডি) নেতা তেজস্বী যাদব ‘মাই বহিন মান যোজনা’ ঘোষণা করেছেন—যেখানে প্রতিটি দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ নারীকে মাসে ২,৫০০ রুপি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে—তবু নীতীশের নারীদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা এখনো তুলনাহীন।
‘এম ফ্যাক্টর’-এর রাজনৈতিক তাৎপর্য
নীতীশের শারীরিক দুর্বলতা ও দীর্ঘ শাসনের ক্লান্তি সত্ত্বেও বিজেপি তাঁকেই এনডিএ-র মুখ করে নির্বাচনে নামিয়েছে, কারণ তাঁর নারীভিত্তিক ভোটব্যাংককে তারা হাতছাড়া করতে চায় না। যদি এনডিএ জেতে, নীতীশ আবারও দলবদল করে বিরোধী মহাগঠবন্ধনের সঙ্গে সরকার গঠনের সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না।
তবে যদি নারীরা তাঁকে আবার ‘পাটলিপুত্রের সিংহাসন’-এ বসান, তাহলে এমএমআরওয়াই প্রকল্পের আদলে অন্যান্য রাজ্যেও অনুরূপ প্রকল্প চালু হতে পারে। নারীদের হাতে টাকা তুলে দেওয়া শুধু তাঁদেরই নয়, তাঁদের পরিবারের জীবনমানও উন্নত করবে—এটাই এই নির্বাচনের বড় শিক্ষা হতে পারে।