০৮:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
নারীদের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ২৩২—ব্যাটিংয়ের পর এবার রক্ষণে স্পিন ভরসা মুন্সীগঞ্জে বাস–অটোরিকশা সংঘর্ষে প্রবীণ দম্পতি নিহত, আহত ৩ দুই বছরের বন্দিদশা শেষে মুক্তির প্রতীক্ষা—গাজার বন্দিশিবির থেকে ঘরে ফিরছেন জেইচিক পরিবারের শেষ দুই সদস্য পদ্মায় ২৫ লাখ বর্গমিটার কারেন্ট জালসহ নৌকা জব্দ, গোয়ালন্দে দুই জেলের কারাদণ্ড টাঙ্গাইলকে ময়মনসিংহ বিভাগে নেওয়ার ‘গুজব’ ঘিরে বিক্ষোভ, মহাসড়ক অবরোধ অর্ধঘণ্টা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯ মাসে ৬০ কোটি টাকার চোরাচালান জব্দ, আটক ৫০১—বিজিবির অভিযান জোরদার আধুনিক সঙ্গীতের উত্তরাধিকার—‘অ্যাভান্ট-গার্ড’ ধারা ও সমকালীন সুরের নতুন ব্যাখ্যা চীনের সেপ্টেম্বর রপ্তানি–আমদানি প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেল এআই-চালিত কর্মবাজারে নতুন দুশ্চিন্তা — সন্তানদের পেশাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভ্রান্ত অভিভাবকরা নদী যেখানে জীবন ও ভয়—ঢাকি নদীর পরিচয়

ভারতের ফ্যাশন জগতে নতুন দিগন্ত—আইআইটি দিল্লির তৈরি বিশ্বের প্রথম ‘ইন্ডিগো ডাইড উল ডেনিম’

রাজস্থানের ধোলপুরের এক কৃষকপুত্র সতেন্দ্র সিং এবং উত্তরপ্রদেশের সিদ্ধার্থনগরের তরুণ ডিজাইনার আনুরাগ গুপ্ত মিলে এমন এক ফ্যাব্রিক তৈরি করেছেন, যা ভারতের টেক্সটাইল ও ফ্যাশন ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখেছে—বিশ্বের প্রথম ইন্ডিগো রঙা উলের ডেনিম। আইআইটি দিল্লির গবেষণাগার থেকে ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের মঞ্চে পৌঁছানো এই উদ্ভাবন প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা ও পরিবেশবান্ধবতার এক অসাধারণ মেলবন্ধন।


উদ্ভাবনের পথে দুই যুবকের যাত্রা

উত্তরপ্রদেশের সিদ্ধার্থনগরের এক ছোট শহরে আনুরাগ গুপ্ত নামের এক তরুণ নিজের বাবার ওষুধের দোকান চালাতে চাইতেন না। বরং তিনি প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়তেন, জানালার ওপারে অন্য জগতের স্বপ্ন দেখতেন। টেলিভিশনে ‘কহো না প্যায়ার হ্যায়’ দেখে তিনি হৃত্বিক রোশনের ফ্যাশন স্টাইলের ভক্ত হয়ে ওঠেন।

অন্যদিকে রাজস্থানের ধোলপুরে এক কৃষকপুত্র সতেন্দ্র সিং পোস্টারে দেখা জেমস ডিনের ডেনিম প্যান্টের দিকে তাকিয়ে ভাবতেন, এমন কাপড় কি তিনি নিজেই তৈরি করতে পারেন? এক দশক পর এই দুই স্বপ্নবাজ যুবক তাঁদের মেধা ও শ্রমে এমন এক সৃষ্টি করেছেন, যা ভারতের টেক্সটাইল ও ফ্যাশন জগতে ইতিহাস তৈরি করেছে—বিশ্বের প্রথম ইন্ডিগো রঙা উলের ডেনিম।


আইআইটি দিল্লি থেকে ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে

৩৫ বছর বয়সী আনুরাগ গুপ্ত এখন প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ডিজাইনার। আর ২৯ বছর বয়সী সতেন্দ্র সিং আইআইটি দিল্লির টেক্সটাইল অ্যান্ড ফাইবার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষক, যিনি এই অভিনব উল ডেনিম আবিষ্কার করেছেন। সিংয়ের তৈরি এই ফ্যাব্রিকই এখন গুপ্তের নতুন সংগ্রহের মূল আকর্ষণ, যা প্রদর্শিত হয়েছে চলমান ল্যাকমে ইন্ডিয়া ফ্যাশন উইকে।

গুপ্তের সংগ্রহে আছে শার্ট, জ্যাকেট, প্যান্ট, ড্রেস ও ওভারলে—সবই উলের তৈরি ডেনিম দিয়ে বানানো, যা হিমাচল প্রদেশের কুল্লু ও ধর্মশালার উল থেকে প্রস্তুত। জাপানি শিল্পী হোকুসাইয়ের বিখ্যাত ঢেউচিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই সংগ্রহে প্রযুক্তি, নান্দনিকতা ও টেকসই উপাদানের মিশ্রণ ঘটানো হয়েছে।

গুপ্ত বলেন, ‘ডেনিম সাধারণত শ্রমজীবী শ্রেণির পোশাক—মজবুত কিন্তু ঠান্ডা আবহাওয়ায় উপযুক্ত নয়। তাই আমি উল নিয়ে পরীক্ষা শুরু করি। আমার লক্ষ্য ছিল এমন উপাদান তৈরি করা, যা প্রযুক্তিনির্ভর, উৎপাদন-বান্ধব ও পরিবেশসম্মত।’


গবেষণাগার থেকে শিল্পে—উল ডেনিমের জন্ম

আইআইটি দিল্লির ইনকিউবেশন ল্যাবে এমটেক শিক্ষার্থী হিসেবে (২০২১–২০২৩) সতেন্দ্র সিং এই ফ্যাব্রিক তৈরি করেন। তিনি জানান, ‘সাধারণ কটন ডেনিমে তাপ নিরোধক ক্ষমতা নেই। আমরা প্লাজমা টেকনোলজি ব্যবহার করেছি—আয়নিত গ্যাসের মাধ্যমে উলের খসখসে স্তর মসৃণ করে তার শক্তি বাড়ানো হয়েছে, ফাইবার নষ্ট না করেই। ফলে এমন উল ডেনিম তৈরি হয়েছে যা মাইনাস ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও একক স্তরে পরা যায়।’

এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে ভারতের টেক্সটাইল মন্ত্রণালয়, এসআইডিবিআই ও কয়েকজন অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর।


পরিবেশবান্ধব ও বহুমুখী কাপড়

এই উল ডেনিম ৩৫ শতাংশ উল ও বাকি অংশে হেম্প, কলা ফাইবার, বাঁশ ও পুনর্ব্যবহৃত কটনের মিশ্রণে তৈরি। এটি সব ঋতুর জন্য উপযুক্ত এবং ঘাম শোষণক্ষম। গুপ্ত বলেন, ‘আপনি ডিসেম্বরের ঠান্ডায় দিল্লি থেকে বিমানে উঠে যদি বেঙ্গালুরু পৌঁছান, তবুও এই পোশাক খুলতে হবে না—এটি ঘাম শুকিয়ে দেয়।’

উলের স্তর সরিয়ে ফেলার ফলে ফ্যাব্রিকটি এখন মেশিনে ধোয়ার উপযোগী ও দ্রুত শুকায়। সিং বলেন, ‘ড্রাই ওয়াশে বিষাক্ত রাসায়নিক লাগে, কিন্তু আমাদের ডেনিমে তা প্রয়োজন নেই।’


জলের ব্যবহার ও কার্বন নিঃসরণে বিশাল হ্রাস

একটি কটন ডেনিম শার্ট তৈরি করতে যেখানে ৩,০০০ লিটার পানি লাগে, সেখানে এই উল ডেনিমে লাগে মাত্র ৭ লিটার। সিং দাবি করেন, ‘আমরা কার্বন নিঃসরণ ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সক্ষম হয়েছি।’ আইআইটি দিল্লিতে তাদের তৈরি মেশিন প্রোটোটাইপ ইতিমধ্যেই বাণিজ্যিক উৎপাদনের উপযোগী বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।


ইন্ডিগোটেক্স: দেশীয় উদ্ভাবনের রপ্তানি

২০২৪ সালে সিং সহ-প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্ডিগোটেক্স’ নামের একটি স্টার্টআপ, যা ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে এই ফ্যাব্রিক রপ্তানি শুরু করেছে। তিনি এখন তুষারাচ্ছন্ন পার্বত্য অঞ্চলের জন্য হাই-অল্টিচিউড পোশাক তৈরি করছেন। তাঁর কথায়, ‘আমরা বর্তমানে ৩.৮ কেজি ওজনের একটি উল ডেনিম জ্যাকেট তৈরি করেছি, লক্ষ্য এটি ২ কেজিতে নামিয়ে আনা।’


সংগ্রামের পথ পেরিয়ে সাফল্যের আলো

আনুরাগ গুপ্ত একসময় নয়ডায় পাঁচজনের সঙ্গে একই ঘরে থাকতেন, বাবার পাঠানো মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় চলতেন। সরকারি স্কুলে পড়া এই তরুণ নিজের ইংরেজি দুর্বলতার কারণে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজিতে ভর্তি হতে পারেননি। পরে তিনি নিজে ইংরেজি শেখেন এবং শেষ পর্যন্ত লুধিয়ানার নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজিতে ভর্তি হন।

২০১৮ সালে তিনি ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার জেননেক্সট শোকেসে প্রথমবারের মতো ফ্যাশন উইকে অংশ নেন। তারপর মণীশ অরোরা ও বরুণ বহলের সঙ্গে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

অন্যদিকে, সতেন্দ্র সিংয়ের জীবনের গল্পও অনুপ্রেরণাদায়ক। সীমিত আয়ের কৃষক পরিবারের সন্তান তিনি। পিতার দেওয়া একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ভর্তি হন জোধপুরের হ্যান্ডলুম টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে, যেখানে স্টাইপেন্ডসহ পড়াশোনা করা সম্ভব ছিল। পরে তিনি সারা ভারতের ডিপ্লোমা পরীক্ষায় প্রথম হন এবং এমএলভি টেক্সটাইল কলেজ, ভিলওয়ারা থেকে বি-টেক সম্পন্ন করেন। ওয়েলস্পান কোম্পানিতে চাকরি করার সময়ই তিনি টেকনিক্যাল টেক্সটাইল বিষয়ক একটি সম্মেলনে আইআইটি দিল্লির সঙ্গে যুক্ত হন। কোভিডের সময় অনলাইন ক্লাস নিয়ে জীবিকা বজায় রেখে এমটেকের জন্য গেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন আইআইটিতে।

আইআইটি দিল্লিতে অধ্যাপক ভূপেন্দ্র সিং বুতোলার তত্ত্বাবধানে লাদাখ সফরের সময় কটন ডেনিমের সীমাবদ্ধতা দেখে উলের ডেনিম তৈরির ধারণা আসে। প্রায় দুই হাজার পরীক্ষার পর তাঁরা সফলভাবে রঙায়ন সম্পন্ন করেন এবং তিন বছরের গবেষণায় তা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসেন।


ভবিষ্যতের পথচলা

আজ আনুরাগ ও সতেন্দ্র দুজনেই ভারতের উদ্ভাবনী ফ্যাশন জগতের নতুন প্রতীক। তাঁদের সহযোগিতায় তৈরি এই ইন্ডিগো ডাইড উল ডেনিম শুধু পোশাক নয়, এটি ভারতীয় প্রযুক্তি, কারিগরি ও সৃজনশীলতার এক অনন্য উদাহরণ।

#tags: ভারতীয়_ফ্যাশন, আইআইটি_দিল্লি, টেকসই_বস্ত্র, ইন্ডিগোটেক্স, আনুরাগ_গুপ্ত, সতেন্দ্র_সিং, উল_ডেনিম, ল্যাকমে_ফ্যাশন_উইক

জনপ্রিয় সংবাদ

নারীদের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ২৩২—ব্যাটিংয়ের পর এবার রক্ষণে স্পিন ভরসা

ভারতের ফ্যাশন জগতে নতুন দিগন্ত—আইআইটি দিল্লির তৈরি বিশ্বের প্রথম ‘ইন্ডিগো ডাইড উল ডেনিম’

০৫:০৭:৫৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

রাজস্থানের ধোলপুরের এক কৃষকপুত্র সতেন্দ্র সিং এবং উত্তরপ্রদেশের সিদ্ধার্থনগরের তরুণ ডিজাইনার আনুরাগ গুপ্ত মিলে এমন এক ফ্যাব্রিক তৈরি করেছেন, যা ভারতের টেক্সটাইল ও ফ্যাশন ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখেছে—বিশ্বের প্রথম ইন্ডিগো রঙা উলের ডেনিম। আইআইটি দিল্লির গবেষণাগার থেকে ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের মঞ্চে পৌঁছানো এই উদ্ভাবন প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা ও পরিবেশবান্ধবতার এক অসাধারণ মেলবন্ধন।


উদ্ভাবনের পথে দুই যুবকের যাত্রা

উত্তরপ্রদেশের সিদ্ধার্থনগরের এক ছোট শহরে আনুরাগ গুপ্ত নামের এক তরুণ নিজের বাবার ওষুধের দোকান চালাতে চাইতেন না। বরং তিনি প্রতিদিন সংবাদপত্র পড়তেন, জানালার ওপারে অন্য জগতের স্বপ্ন দেখতেন। টেলিভিশনে ‘কহো না প্যায়ার হ্যায়’ দেখে তিনি হৃত্বিক রোশনের ফ্যাশন স্টাইলের ভক্ত হয়ে ওঠেন।

অন্যদিকে রাজস্থানের ধোলপুরে এক কৃষকপুত্র সতেন্দ্র সিং পোস্টারে দেখা জেমস ডিনের ডেনিম প্যান্টের দিকে তাকিয়ে ভাবতেন, এমন কাপড় কি তিনি নিজেই তৈরি করতে পারেন? এক দশক পর এই দুই স্বপ্নবাজ যুবক তাঁদের মেধা ও শ্রমে এমন এক সৃষ্টি করেছেন, যা ভারতের টেক্সটাইল ও ফ্যাশন জগতে ইতিহাস তৈরি করেছে—বিশ্বের প্রথম ইন্ডিগো রঙা উলের ডেনিম।


আইআইটি দিল্লি থেকে ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে

৩৫ বছর বয়সী আনুরাগ গুপ্ত এখন প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ডিজাইনার। আর ২৯ বছর বয়সী সতেন্দ্র সিং আইআইটি দিল্লির টেক্সটাইল অ্যান্ড ফাইবার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষক, যিনি এই অভিনব উল ডেনিম আবিষ্কার করেছেন। সিংয়ের তৈরি এই ফ্যাব্রিকই এখন গুপ্তের নতুন সংগ্রহের মূল আকর্ষণ, যা প্রদর্শিত হয়েছে চলমান ল্যাকমে ইন্ডিয়া ফ্যাশন উইকে।

গুপ্তের সংগ্রহে আছে শার্ট, জ্যাকেট, প্যান্ট, ড্রেস ও ওভারলে—সবই উলের তৈরি ডেনিম দিয়ে বানানো, যা হিমাচল প্রদেশের কুল্লু ও ধর্মশালার উল থেকে প্রস্তুত। জাপানি শিল্পী হোকুসাইয়ের বিখ্যাত ঢেউচিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই সংগ্রহে প্রযুক্তি, নান্দনিকতা ও টেকসই উপাদানের মিশ্রণ ঘটানো হয়েছে।

গুপ্ত বলেন, ‘ডেনিম সাধারণত শ্রমজীবী শ্রেণির পোশাক—মজবুত কিন্তু ঠান্ডা আবহাওয়ায় উপযুক্ত নয়। তাই আমি উল নিয়ে পরীক্ষা শুরু করি। আমার লক্ষ্য ছিল এমন উপাদান তৈরি করা, যা প্রযুক্তিনির্ভর, উৎপাদন-বান্ধব ও পরিবেশসম্মত।’


গবেষণাগার থেকে শিল্পে—উল ডেনিমের জন্ম

আইআইটি দিল্লির ইনকিউবেশন ল্যাবে এমটেক শিক্ষার্থী হিসেবে (২০২১–২০২৩) সতেন্দ্র সিং এই ফ্যাব্রিক তৈরি করেন। তিনি জানান, ‘সাধারণ কটন ডেনিমে তাপ নিরোধক ক্ষমতা নেই। আমরা প্লাজমা টেকনোলজি ব্যবহার করেছি—আয়নিত গ্যাসের মাধ্যমে উলের খসখসে স্তর মসৃণ করে তার শক্তি বাড়ানো হয়েছে, ফাইবার নষ্ট না করেই। ফলে এমন উল ডেনিম তৈরি হয়েছে যা মাইনাস ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও একক স্তরে পরা যায়।’

এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে ভারতের টেক্সটাইল মন্ত্রণালয়, এসআইডিবিআই ও কয়েকজন অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর।


পরিবেশবান্ধব ও বহুমুখী কাপড়

এই উল ডেনিম ৩৫ শতাংশ উল ও বাকি অংশে হেম্প, কলা ফাইবার, বাঁশ ও পুনর্ব্যবহৃত কটনের মিশ্রণে তৈরি। এটি সব ঋতুর জন্য উপযুক্ত এবং ঘাম শোষণক্ষম। গুপ্ত বলেন, ‘আপনি ডিসেম্বরের ঠান্ডায় দিল্লি থেকে বিমানে উঠে যদি বেঙ্গালুরু পৌঁছান, তবুও এই পোশাক খুলতে হবে না—এটি ঘাম শুকিয়ে দেয়।’

উলের স্তর সরিয়ে ফেলার ফলে ফ্যাব্রিকটি এখন মেশিনে ধোয়ার উপযোগী ও দ্রুত শুকায়। সিং বলেন, ‘ড্রাই ওয়াশে বিষাক্ত রাসায়নিক লাগে, কিন্তু আমাদের ডেনিমে তা প্রয়োজন নেই।’


জলের ব্যবহার ও কার্বন নিঃসরণে বিশাল হ্রাস

একটি কটন ডেনিম শার্ট তৈরি করতে যেখানে ৩,০০০ লিটার পানি লাগে, সেখানে এই উল ডেনিমে লাগে মাত্র ৭ লিটার। সিং দাবি করেন, ‘আমরা কার্বন নিঃসরণ ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সক্ষম হয়েছি।’ আইআইটি দিল্লিতে তাদের তৈরি মেশিন প্রোটোটাইপ ইতিমধ্যেই বাণিজ্যিক উৎপাদনের উপযোগী বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।


ইন্ডিগোটেক্স: দেশীয় উদ্ভাবনের রপ্তানি

২০২৪ সালে সিং সহ-প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্ডিগোটেক্স’ নামের একটি স্টার্টআপ, যা ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে এই ফ্যাব্রিক রপ্তানি শুরু করেছে। তিনি এখন তুষারাচ্ছন্ন পার্বত্য অঞ্চলের জন্য হাই-অল্টিচিউড পোশাক তৈরি করছেন। তাঁর কথায়, ‘আমরা বর্তমানে ৩.৮ কেজি ওজনের একটি উল ডেনিম জ্যাকেট তৈরি করেছি, লক্ষ্য এটি ২ কেজিতে নামিয়ে আনা।’


সংগ্রামের পথ পেরিয়ে সাফল্যের আলো

আনুরাগ গুপ্ত একসময় নয়ডায় পাঁচজনের সঙ্গে একই ঘরে থাকতেন, বাবার পাঠানো মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় চলতেন। সরকারি স্কুলে পড়া এই তরুণ নিজের ইংরেজি দুর্বলতার কারণে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজিতে ভর্তি হতে পারেননি। পরে তিনি নিজে ইংরেজি শেখেন এবং শেষ পর্যন্ত লুধিয়ানার নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব ফ্যাশন টেকনোলজিতে ভর্তি হন।

২০১৮ সালে তিনি ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার জেননেক্সট শোকেসে প্রথমবারের মতো ফ্যাশন উইকে অংশ নেন। তারপর মণীশ অরোরা ও বরুণ বহলের সঙ্গে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

অন্যদিকে, সতেন্দ্র সিংয়ের জীবনের গল্পও অনুপ্রেরণাদায়ক। সীমিত আয়ের কৃষক পরিবারের সন্তান তিনি। পিতার দেওয়া একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ভর্তি হন জোধপুরের হ্যান্ডলুম টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে, যেখানে স্টাইপেন্ডসহ পড়াশোনা করা সম্ভব ছিল। পরে তিনি সারা ভারতের ডিপ্লোমা পরীক্ষায় প্রথম হন এবং এমএলভি টেক্সটাইল কলেজ, ভিলওয়ারা থেকে বি-টেক সম্পন্ন করেন। ওয়েলস্পান কোম্পানিতে চাকরি করার সময়ই তিনি টেকনিক্যাল টেক্সটাইল বিষয়ক একটি সম্মেলনে আইআইটি দিল্লির সঙ্গে যুক্ত হন। কোভিডের সময় অনলাইন ক্লাস নিয়ে জীবিকা বজায় রেখে এমটেকের জন্য গেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন আইআইটিতে।

আইআইটি দিল্লিতে অধ্যাপক ভূপেন্দ্র সিং বুতোলার তত্ত্বাবধানে লাদাখ সফরের সময় কটন ডেনিমের সীমাবদ্ধতা দেখে উলের ডেনিম তৈরির ধারণা আসে। প্রায় দুই হাজার পরীক্ষার পর তাঁরা সফলভাবে রঙায়ন সম্পন্ন করেন এবং তিন বছরের গবেষণায় তা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসেন।


ভবিষ্যতের পথচলা

আজ আনুরাগ ও সতেন্দ্র দুজনেই ভারতের উদ্ভাবনী ফ্যাশন জগতের নতুন প্রতীক। তাঁদের সহযোগিতায় তৈরি এই ইন্ডিগো ডাইড উল ডেনিম শুধু পোশাক নয়, এটি ভারতীয় প্রযুক্তি, কারিগরি ও সৃজনশীলতার এক অনন্য উদাহরণ।

#tags: ভারতীয়_ফ্যাশন, আইআইটি_দিল্লি, টেকসই_বস্ত্র, ইন্ডিগোটেক্স, আনুরাগ_গুপ্ত, সতেন্দ্র_সিং, উল_ডেনিম, ল্যাকমে_ফ্যাশন_উইক