গাজা যুদ্ধ ও ট্রাম্পের ‘শান্তি পরিকল্পনা’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাধারণত বিদেশি নেতাদের প্রকাশ্যে প্রশংসা করেন না। কিন্তু ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুইবার তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। কারণ, ট্রাম্প সম্প্রতি ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ বন্ধে ২০ দফার এক ‘শান্তি পরিকল্পনা’ ঘোষণা করেছিলেন, যেটিকে মোদি আখ্যা দেন “গাজা সংকটের একটি সমন্বিত সমাধান পরিকল্পনা” হিসেবে।
৩০ সেপ্টেম্বর মোদি বলেন, “এই পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য কার্যকর পথ দেখায়—প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েল উভয়ের জন্যই।” তিনি এই বিবৃতি দেন সাতটি ভাষায়—আরবি, চীনা, ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, স্প্যানিশ, হিব্রু ও হিন্দিতে। এরপর ৪ অক্টোবর তিনি আরও একবার ট্রাম্পের প্রশংসা করে বলেন, “গাজার শান্তি প্রচেষ্টায় ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমরা আশাবাদী।”
বর্তমানে হামাস ও ইসরায়েল এই পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সম্মত হয়েছে—হামাস জিম্মিদের মুক্তি দেবে এবং ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবে। যদিও যুদ্ধবিরতির সময়সীমা এখনো নির্দিষ্ট নয়। গাজা ও ইসরায়েল উভয় স্থানেই মানুষ রাস্তায় নেমে উদযাপন করেছে। তবে হামাস এখনো পুরো পরিকল্পনা মেনে নেয়নি, বিশেষত বাইরের কোনো কর্তৃপক্ষকে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দিতে তারা অনিচ্ছুক।
মোদির অস্বাভাবিক প্রশংসার পেছনের প্রশ্ন
বিশ্লেষকদের প্রশ্ন—ট্রাম্প যিনি শুরু থেকেই ভারতের অর্থনীতি ও কূটনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন, তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী কেন এত আগ্রহী?
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে (২০১৭-২০২১) ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন—ইস্পাতে ২৫% ও অ্যালুমিনিয়ামে ১০%। পাশাপাশি ভারতের জিএসপি (Generalized System of Preferences) সুবিধাও বাতিল করেছিলেন। ২০২০ সালে তিনি ভারতীয় নাগরিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিসা বিভাগ, বিশেষ করে H-1B ভিসা, স্থগিত করেছিলেন।
এমনকি ২০১৯ সালে টেক্সাসের হিউস্টনে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় মোদি ট্রাম্পের পক্ষে ঘোষণা দিয়েছিলেন—“আব কি বার, ট্রাম্প সরকার!” (এবার ট্রাম্প সরকার)।
দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের কঠোর অবস্থান
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ভারতের ওপর আরও কঠোর অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইস্পাত, বস্ত্র, ওষুধ, রত্ন, সামুদ্রিক খাবার, আসবাব, গাড়ি, এমনকি খেলনার রপ্তানিতেও উচ্চ শুল্ক আরোপ করে ভারতের রপ্তানি কার্যত থামিয়ে দিয়েছেন।
তিনি অভিযোগ করেছেন, ভারত “রাশিয়া থেকে তেল কিনে ইউক্রেনবিরোধী যুদ্ধকে অর্থায়ন করছে।” এর জবাবে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক বসিয়েছেন। তার ঘনিষ্ঠ সেনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—“তোমরা যদি রাশিয়া থেকে তেল কেনা না বন্ধ করো, আমরা তোমাদের অর্থনীতি চূর্ণবিচূর্ণ করে দেব।”
শুধু তাই নয়, ট্রাম্প ভারতকে ‘ট্যারিফ কিং’ আখ্যা দেন, আর তার বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো ভারত-রাশিয়া সম্পর্ককে “দুই মৃত অর্থনীতি” বলে কটাক্ষ করেন। নতুন নিয়মে H-1B ভিসার ফি বাড়িয়ে ১ লাখ মার্কিন ডলার করা হয়, এবং ছাত্র ও স্বামী/স্ত্রীর ভিসা শর্তও কঠোর করা হয়।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১,০০০-এরও বেশি ভারতীয়কে “অবৈধ অভিবাসী” হিসেবে সামরিক বিমানে হাতকড়া ও পায়ে শিকল বেঁধে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়।
পাকিস্তানের প্রতি ট্রাম্পের পক্ষপাত
ভারতের বিরোধিতা সত্ত্বেও পাকিস্তান ২০২৫ সালের মে-জুনে বিশাল আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা পায়—আইএমএফ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার, এডিবি থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলার, এবং বিশ্বব্যাংক থেকে ৪.০ বিলিয়ন ডলার—যার পেছনে ট্রাম্প প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
ট্রাম্প দাবি করেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত শেষ করতে তিনিই মধ্যস্থতা করেছেন—যদিও ভারত তা অস্বীকার করেছে। ১৮ জুন তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানান—যা ইতিহাসে নজিরবিহীন। এরপর ২৫ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানকে নিয়ে যৌথ বৈঠক করেন। সেখানে পাকিস্তান ‘দুর্লভ খনিজ’ সরবরাহের প্রস্তাব দেয়, ১৯% শুল্কে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আরব সাগরে বন্দর নির্মাণ ও পরিচালনার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
এতে স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি এখন পাকিস্তানকে পুরনো “সন্ত্রাসের আশ্রয়স্থল” নয়, বরং নতুন কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখছে।
‘ডাউন এস্কেলেটরে’ ভারতের নীতির অবস্থা
২০২৫ সালের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পদক্ষেপই ভারতের পক্ষে যায়নি। দুই দেশের সম্পর্ক যেন ‘ডাউন এস্কেলেটরে’ দাঁড়িয়ে আছে, আর মোদি সেই চলমান সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে চাইছেন।
বিশ্লেষক পি. চিদাম্বরম মন্তব্য করেন, মোদির এই অতিরিক্ত ট্রাম্পপ্রীতি ভারতের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও কূটনৈতিক দুর্বলতারই প্রতিফলন।
গাজার ভবিষ্যৎ: এক মৃত স্বপ্ন
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার ১৯ নম্বর ধারা বলছে—“গাজার পুনর্গঠন চলাকালে এবং প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের সংস্কার কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হলে তবেই প্যালেস্টাইনের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরি হতে পারে।”
চিদাম্বরমের মতে, যুদ্ধ হয়তো থেমে যাবে, জিম্মিদের মুক্তি মিলবে বা তাদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে দেওয়া হবে, এবং মানবিক সহায়তা গাজায় পৌঁছাবে। কিন্তু গাজা নিজেই পরিণত হবে এক ‘অরাজনৈতিক কমিটি’র অধীনস্থ উপনিবেশে—যার তত্ত্বাবধানে থাকবে ‘বোর্ড অব পিস’, যেখানে ট্রাম্প ও টনি ব্লেয়ারের মতো নেতারা সিদ্ধান্ত নেবেন।
এমন পরিস্থিতিতে প্যালেস্টাইনের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন কার্যত মরে গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়তো বুঝেছেন, বিশ্বের মঞ্চে এখন ভারতের বন্ধু খুব কম, আর দেশের অর্থনীতি বৈশ্বিক ঝড় সামলানোর মতো স্থিতিশীল নয়।
চিদাম্বরমের শেষ মন্তব্য—“চাটুকারিতা কোনোদিনও বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতি, কার্যকর বাণিজ্যনীতি বা টেকসই বিনিয়োগনীতির বিকল্প হতে পারে না।”
# ভারত-মার্কিন-সম্পর্ক, #ডোনাল্ড-ট্রাম্প,# নরেন্দ্র-মোদি,# গাজা-সংকট, #প্যালেস্টাইন,# আন্তর্জাতিক-রাজনীতি, #পি-চিদাম্বরম, #বিশ্বকূটনীতি