দক্ষিণ আমেরিকার ভূমিবেষ্টিত দেশ বলিভিয়ায় কোকা পাতা কেবল একটি ফসল নয়—এটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরিচয়ের প্রতীক। হাজার বছরের পুরোনো আন্দিয়ান ঐতিহ্যে এই পাতা চিবানো, চা বানানো ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে কোকা দীর্ঘদিন ধরে ‘কোকেইনের মূল উপাদান’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় এটি মাদকদ্রব্যের তালিকায় পড়েছে। এখন বলিভিয়া জাতিসংঘে আবেদন করছে, যেন কোকা পাতাকে এই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
ঐতিহ্য বনাম নিষেধাজ্ঞা
দীর্ঘ দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোকা গাছ ধ্বংসের অভিযান চলছে। আন্দিয়ান অঞ্চলে পুলিশের হাতে গাছ উপড়ে ফেলা, কোকেইন দমনে বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প—এসবই এর অংশ। কিন্তু বলিভিয়ায় কোকা চাষ, বিক্রি ও ভোগ বৈধ। দেশটির আন্দিয়ান জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে, কোকা কোনো ক্ষতিকর পদার্থ নয়, বরং এটি জীবনযাত্রার অংশ।
লাপাজের সান হোসে দে পেরি শহরে সরকারিভাবে কোকা চাষের ভিডিও ধারণ করা হয় জনসচেতনতার জন্য। কৃষক হাইমে মামানি বলেন, “এই তিন-দাঁতওয়ালা যন্ত্র দিয়ে মাটি খুঁড়ে গাছের চারা লাগানো হয়, এভাবেই কোকা জন্ম নেয়।”
জাতিসংঘের তালিকা থেকে অপসারণের প্রচেষ্টা
বর্তমানে জাতিসংঘ কোকাকে ফেন্টানিল ও হেরোইনের সঙ্গে ‘উচ্চ আসক্তিজনক ও অপব্যবহারযোগ্য পদার্থ’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এ অবস্থান পরিবর্তনের বিরোধিতা করছে, কারণ এতে কোকেইন উৎপাদন বাড়তে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
তবু বলিভিয়ার নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক প্রচার চলছে, যাতে কোকা পাতাকে ‘অতিবিপজ্জনক’ তালিকা থেকে সরিয়ে কম নিয়ন্ত্রিত শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, শিল্পোন্নয়ন ও বৈধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ খুলে যেতে পারে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত ২০২৬ সালের মার্চে আসতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোকা পাতার আসক্তি সৃষ্টির সম্ভাবনা খুব কম এবং এটি বড় কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে না।
বলিভিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বলিভিয়ার ইতিহাসে কোকা আন্দোলন গভীরভাবে জড়িত রাজনীতির সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী যুদ্ধ আন্দিয়ান আদিবাসীদের ক্ষুব্ধ করেছিল। এই আন্দোলনের ফলেই ২০০৬ সালে ইভো মোরালেস, একজন কোকা চাষি ইউনিয়ন নেতা, দেশের প্রথম আদিবাসী প্রেসিডেন্ট হন।
মোরালেস সরকার “কোকা হ্যাঁ, কোকেইন না” স্লোগানে কোকা চাষ ও পণ্যের বৈধতা নিশ্চিত করে—চা, ময়দা, টুথপেস্ট, এমনকি প্রসাধনী পর্যন্ত উৎপাদনে এটি ব্যবহার শুরু হয়। ২০০৯ সালের সংবিধানে কোকাকে জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করা হয়।
২০১২ সালে বলিভিয়া জাতিসংঘের মাদক চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং ২০১৩ সালে পুনরায় যোগ দেয়, তবে কোকা ব্যবহারের জন্য বিশেষ ছাড় পায়। ২০১৭ সালে দেশটি কোকা চাষ, বাণিজ্য ও ভোগ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন করে।
কোকা শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বলিভিয়ায় আনুমানিক ২২,০০০ হেক্টর জমিতে বৈধ কোকা চাষ হয়। এই খাত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার পরিবারের জীবিকা দেয়। কৃষকেরা ভোর তিনটায় কাজ শুরু করেন, পাতা শুকিয়ে বাজারজাত করেন এবং সরকারি বাজারে বিক্রি করেন।
কোকা পাতা এখন সর্বত্র—হোটেলের চা ব্যাগে, রাস্তার দোকানে বিভিন্ন স্বাদে বিক্রি হয়, ট্রাকচালকরা দীর্ঘ যাত্রায় চিবান, এমনকি সরকারি দপ্তরের টেবিলেও রাখা থাকে।
সরকারি কর্মকর্তা ওমার পিন্তোনেস বলেন, “ছোটবেলায় কোকা ভোগকে নিম্নবিত্তের কাজ মনে করা হতো। এখন আইনজীবী, ডাক্তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সবাই ব্যবহার করেন।”
নতুন উদ্যোগ ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা
রাষ্ট্রপতি লুইস আরসে ২০২০ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর কোকাকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও শিল্প পণ্যে রূপান্তরের উদ্যোগ নেন। তার সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছে কোকাকে বিপজ্জনক পদার্থের তালিকা থেকে অপসারণের জন্য।
দেশটির কোকা ও সমন্বিত উন্নয়ন বিষয়ক উপমন্ত্রণালয় শিল্প খাতে নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবনে কাজ করছে—কোকা সোডা, আইসক্রিম, মলম, সিরাপ ও সাবান তৈরিতে পরীক্ষা চলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কোকা পাতা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, মনোযোগ বৃদ্ধি ও প্রদাহনাশক উপাদানে কার্যকর হতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, কোকা পাতা বৈধ করা মানে কোকেইন উৎপাদন বাড়ানোর ঝুঁকি। তাদের মতে, আন্তর্জাতিকভাবে কোকা স্বীকৃতি পেলে চাষ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।
তবে সমর্থকেরা বলছেন, সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত বৈধ বাজার গড়ে তোলা গেলে ঐতিহ্যবাহী ব্যবহারের সঙ্গে কোকেইন পাচারকে আলাদা করা সম্ভব। বলিভিয়ার উপমন্ত্রী মাতেও মামানি জানান, কোকা রপ্তানি বৈধ হলে “রাষ্ট্রের রাজস্ব বাড়বে এবং হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।”
ঐতিহাসিক আশঙ্কা
সমাজবিজ্ঞানী সডেনকা সিলভা, যিনি লাপাজে ‘মিউজিয়াম অব কোকা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, মনে করেন, যদি আন্তর্জাতিক বাজার খুলে যায়, তাহলে বড় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লাভবান হবে, আর স্থানীয় আদিবাসীরা বঞ্চিত থাকবে। তার আশঙ্কা, ঔপনিবেশিক যুগের মতোই আবার উন্নত দেশগুলো সস্তায় কোকা চাষ করে বলিভিয়াকে পেছনে ফেলতে পারে।
বলিভিয়ার বর্তমান সরকার বলছে, কোকা কোনো মাদক নয়, বরং আন্দিয়ান সংস্কৃতির জীবন্ত প্রতীক। প্রেসিডেন্ট আরসে বলেন, “এটি রাজনৈতিক ইস্যু নয়। কোকা পাতা মাদক নয়, এটি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ।”
জাতিসংঘের সামনে এখন এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত—হাজার বছরের ঐতিহ্যকে পুনর্মূল্যায়ন করে কোকাকে সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে, নাকি আগের মতোই মাদকের তালিকায় রাখা হবে।