বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ও ঋণচাপের মতো নানা সংকট বিদ্যমান। এর মধ্যেও গত দুই সপ্তাহে শেয়ারবাজারে দেখা গেছে অস্থিরতার পাশাপাশি সামান্য আশাবাদের ইঙ্গিত। একদিকে সূচকের ওঠানামা বিনিয়োগকারীদের দ্বিধায় ফেলেছে, অন্যদিকে কিছু কোম্পানির পারফরম্যান্স বাজারে আংশিক আস্থা ফিরিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে—এই অনিশ্চিত অর্থনৈতিক পরিবেশে শেয়ারবাজার কি আবার স্থিতিশীল পথে ফিরতে পারবে?
গত দুই সপ্তাহের বাজারধারা
সূচকের ওঠানামা ও বিনিয়োগকারীর প্রতিক্রিয়া
গত দুই সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের দোলাচল ছিল উল্লেখযোগ্য। এক পর্যায়ে DSEX সূচক প্রথম ঘণ্টার লেনদেনে ৪৪ পয়েন্ট পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী হয়, তবে শেষ ঘণ্টাগুলোতে সেই গতি ধরে রাখতে পারেনি। একই সময়ে ২৭১টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে ১৫০টির শেয়ারমূল্য বেড়েছে, ৬৪টি কমেছে এবং ৫৭টি অপরিবর্তিত ছিল।
অন্যদিকে, Z-ক্যাটেগরির শেয়ারগুলোর মধ্যে ৫২ শতাংশের দাম হ্রাস পায়, যা বাজারের ঝুঁকি ও দুর্বল শেয়ারের চাপকে স্পষ্ট করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, “প্রথম ঘণ্টায় সূচক ঊর্ধ্বমুখী হলেও সারাদিনের লেনদেনে বাজার ছিল মিশ্র।”
বাজার গভীরতা ও লেনদেন প্রবাহ
বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার অংশগ্রহণ এখনো পুরোপুরি সমান নয়। অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী এখনো অপেক্ষার কৌশল নিচ্ছেন, ফলে বাজারে তরলতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। যদিও একদিনে ডিএসইতে ১২ হাজার কোটি টাকার টার্নওভার অতিক্রম করার খবর কিছুটা আশাবাদ তৈরি করেছে—যা গত এক বছরের মধ্যে বিরল ঘটনা। বিশ্লেষকদের মতে, এটি “অপ্রচলিত হলেও ইতিবাচক সংকেত”, যা প্রমাণ করে বাজারে কিছু নতুন বিনিয়োগ প্রবাহ শুরু হয়েছে।
বাজার স্থিতিশীলতার পথে চ্যালেঞ্জ
অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট
মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের ঘাটতি ও বৈদেশিক ঋণপরিশোধের চাপ বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। ব্যবসায়িক খরচ বৃদ্ধি এবং আমদানি সীমাবদ্ধতা কোম্পানিগুলোর মুনাফায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
দুর্বল শেয়ার ও নিয়ন্ত্রক চ্যালেঞ্জ
Z-ক্যাটেগরির শেয়ারগুলোর অব্যাহত পতন বাজারে আস্থা হ্রাস করছে। একই সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রকদের কার্যকর নজরদারি ও স্বচ্ছতার অভাবও বিনিয়োগকারীদের অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রভাব
বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা, মার্কিন সুদের হার বৃদ্ধি এবং পণ্যমূল্যের ওঠানামা বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে চাপ সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বাজারে পুঁজি সরিয়ে নিচ্ছে, যা স্থানীয় বাজারের স্থিতি ব্যাহত করছে।
সম্ভাবনা ও পুনরুদ্ধারের দিগন্ত
বিদেশি ও প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের সুযোগ
যদি বাংলাদেশ সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নীতিগত সহায়তা ও কর সুবিধা বাড়াতে পারে, তাহলে নতুন মূলধন প্রবাহ শেয়ারবাজারে স্থিতি আনতে পারে।
কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি ও বাজার আস্থা
দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও খরচ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়লে বাজারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। শক্তিশালী কোম্পানির পারফরম্যান্স বাজার আস্থা পুনর্গঠনে সহায়ক হবে।
স্বচ্ছতা ও নিয়মের প্রয়োগ
যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থা সময়োপযোগী সংস্কার আনে—যেমন তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা, ম্যানিপুলেশন প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া—তাহলে বিনিয়োগকারীরা পুনরায় আস্থা ফিরে পেতে পারেন।
স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা কোথায়?
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে অর্থনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক প্রভাব, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট—সব মিলিয়ে বাজার এখনো নড়বড়ে অবস্থায়।
যদি নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, কোম্পানিগুলো মুনাফা বাড়াতে সক্ষম হয় এবং বিনিয়োগকারীরা মধ্যম-মেয়াদি কৌশল গ্রহণ করেন, তাহলে বাজার আংশিক স্থিতি অর্জন করতে পারে। আপাতত “উত্থান-পতনমুক্ত” বাজারের আশা করা অবাস্তব ।
#শেয়ারবাজার #ঢাকাস্টকএক্সচেঞ্জ #বিনিয়োগ #অর্থনীতি #বাজারবিশ্লেষণ #বিনিয়োগকারীরআস্থা #বাংলাদেশ