প্রকল্প ঘিরে নতুন দেনা-আলোচনা
ইন্দোনেশিয়ার সরকার তাদের উচ্চগতির রেল প্রকল্পের ক্রমবর্ধমান লোকসান সামাল দিতে চীনের সঙ্গে দেনা পুনর্গঠনের আলোচনা শুরু করেছে। বিনিয়োগ ও নিম্নমুখী শিল্পমন্ত্রী রোসান রোসলানি গত সপ্তাহে জানান, দেনা পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা চলছে এবং সরকার প্রকল্পটিকে খেলাপির হাত থেকে বাঁচাতে “সামগ্রিক সংস্কার” আনতে চায়।
দেশটির ‘হুউশ’ (Whoosh) দ্রুতগতির রেলপথ, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম বাণিজ্যিক হাই-স্পিড ট্রেন, ২০২৩ সালের অক্টোবরে চালু হয়। এটি রাজধানী জাকার্তা থেকে পশ্চিম জাভার বানডুং শহর পর্যন্ত ১৪০ কিলোমিটার পথ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটার গতিতে অতিক্রম করে।
যাত্রী সংখ্যা কম, আয় প্রত্যাশার নিচে
প্রথম দুই বছরে প্রায় ১ কোটি যাত্রী পরিবহন করলেও স্টেশনগুলোর অপ্রত্যাশিত অবস্থান ও ছোট রুটের কারণে ব্যবহার ধীরগতিতে বাড়ছে। পরিচালন সংস্থা কেরেতা সেপাত ইন্দোনেশিয়া চায়না (KCIC)-এর তথ্য অনুযায়ী, সপ্তাহের দিনে দৈনিক গড়ে ১৬ থেকে ১৮ হাজার এবং ছুটির দিনে ১৮ থেকে ২১ হাজার যাত্রী রেলটি ব্যবহার করছে—যা প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ৫০ থেকে ৭৬ হাজারের অর্ধেকেরও কম।
একজন বানডুং-এর ব্যবসায়ী বলেন, “আগে জাকার্তা যেতে গাড়িতে চার ঘণ্টা লাগত, এখন মাত্র ৪০ মিনিটেই যাওয়া যায়। জীবন অনেক সহজ হয়েছে।” তবে সরকারি রিপোর্ট বলছে, টিকিট বিক্রি ও আয় দিয়ে এখনো সুদ পরিশোধই সম্ভব হচ্ছে না।
বিপুল ক্ষতি ও দায়ভার বেড়েই চলেছে
কেএসিআইসি কনসোর্টিয়ামের ৬০ শতাংশ মালিক ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর জোট এবং ৪০ শতাংশ চীনা কোম্পানির। রাষ্ট্রীয় অংশীদাররা ২০২৪ সালে ৪.২ ট্রিলিয়ন রুপিয়া (প্রায় ২৫৩ মিলিয়ন ডলার) লোকসান দেখিয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুন মেয়াদে লোকসান দাঁড়ায় ১.৬৩ ট্রিলিয়ন রুপিয়া। জুন শেষে মোট দায় দাঁড়ায় ১৮.৯৩ ট্রিলিয়ন রুপিয়ায়। কেএসিআইসি সামগ্রিকভাবে আরও বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
রাষ্ট্রীয় রেল সংস্থা কেরেতা আপি ইন্দোনেশিয়ার (KAI) প্রেসিডেন্ট ডিরেক্টর ববি রাসিদিন সংসদীয় কমিটিতে বলেন, “এই প্রকল্পের দেনা এখন একপ্রকার ‘টিকটিক করা টাইম বোমা’।”
চীনের অর্থায়ন ও বেল্ট অ্যান্ড রোড সংযোগ
এই প্রকল্পটি চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের অংশ হিসেবে নির্মিত হয়, যেখানে চীন আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়। মোট প্রকল্প ব্যয় ৭.২ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৫.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
প্রাথমিকভাবে ইন্দোনেশিয়া জাপানের শিনকানসেন বুলেট ট্রেন প্রযুক্তি নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে জোকো উইদোদো সরকারের সময়ে সিদ্ধান্ত বদলে চীনা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, কারণ এতে সরকারি গ্যারান্টি বা অতিরিক্ত বাজেট চাপের প্রয়োজন পড়বে না বলে মনে করা হয়েছিল।
আশাবাদ থেকে আর্থিক বিপর্যয়
অতিরিক্ত আশাবাদ ও নির্মাণ বিলম্বের কারণে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু তা ১.২ বিলিয়ন ডলার বাড়ে। শুধু সুদের পরিমাণই বছরে প্রায় ১২ কোটি ডলার। প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল, ট্রেন চালু হওয়ার পর আয় থেকেই ঋণ শোধ করা যাবে। কিন্তু যাত্রীসংখ্যা প্রত্যাশার চেয়ে কম হওয়ায় সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
প্রিমিয়াম ইকোনমি টিকিট মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব করলে বার্ষিক আয় প্রায় ১১ কোটি ডলার, অথচ শুধু রক্ষণাবেক্ষণ ও কর্মীদের বেতন মিটিয়েই এই আয় শেষ হয়ে যায়।
সরকারি তহবিলের ওপর বাড়ছে চাপ
প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার ইতিমধ্যে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ দিচ্ছে। নতুন দেনা পুনর্গঠন হলে আরও তহবিল ব্যয়ের সম্ভাবনা আছে। সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত ফান্ড ‘দানাতারা ইন্দোনেশিয়া’ কেএসিআইসিতে মূলধন যোগ করার পরিকল্পনা করছে, যাতে সংস্থাটি টিকে থাকতে পারে। ফান্ডটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা দনি ওসকারিয়া বলেন, “আমরা বিবেচনা করছি, কেএসিআইসি যেন নিজে থেকে টিকে থাকতে পারে, সেজন্য মূলধন বাড়ানো বা রেল অবকাঠামো সরকারকে হস্তান্তর করার বিকল্প নিয়ে ভাবছি।”
সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
সরকার যাত্রী বাড়ানোর জন্য ট্রেনলাইনটি ৫০০ কিলোমিটার বাড়িয়ে সুরাবায়া পর্যন্ত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। কিন্তু দেনা সঙ্কট প্রকল্পটির সম্প্রসারণকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। অর্থনীতি ও আইন গবেষণা কেন্দ্রের বিশ্লেষক বিমা উদ্যিষ্টিরা বলেন, “দেনা পুনর্গঠনের ফলে সরকারের ও সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের ওপর আরও আর্থিক চাপ বাড়বে। আগের সরকারকেও এর দায় নিতে হবে।”
#ইন্দোনেশিয়া, চীন, উচ্চগতির রেল, বেল্ট অ্যান্ড রোড, দেনা পুনর্গঠন, জাকার্তা-বানডুং রেল, অর্থনীতি, অবকাঠামো, এশিয়া