ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা খুব শিগগিরই ইউরোপের প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে শুল্কমুক্ত (জিরো-ডিউটি) প্রবেশাধিকার পেতে চলেছেন। তিনটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) মধ্যে ইএফটিএ ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে চুক্তি প্রায় সম্পন্ন, আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে আলোচনাও দ্রুত এগোচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই বড় অগ্রগতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা ভারতের রপ্তানি ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় নতুন গতি আনবে।
আলোচনার বর্তমান অবস্থা
১০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ভারত-ইইউ বাণিজ্য আলোচনার ১৪তম রাউন্ডে “গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা” হয়। ইইউ—যার অর্থনীতির আকার প্রায় ১৯.৯৯ ট্রিলিয়ন ডলার—এর সঙ্গে এফটিএ এখন দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। বেশ কিছু সংবেদনশীল বিষয় মীমাংসার পথে, বিশেষ করে মোটরগাড়ি খাতে অ-শুল্ক বাধা নিয়ে আলোচনা চলছে। উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শিগগিরই হতে পারে, যাতে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ চুক্তি সম্পন্ন হয়।
ব্রাসেলসে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ
বাণিজ্য সচিব রাজেশ আগরওয়াল ১০ অক্টোবর ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কমিশনের ট্রেড অ্যান্ড ইকনমিক সিকিউরিটির ডিরেক্টরেট জেনারেল সাবিনে ভেইয়্যান্ডের সঙ্গে বৈঠক করেন। উভয় পক্ষ ভার্চুয়াল ও সরাসরি ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে অবশিষ্ট ইস্যুগুলোর নিষ্পত্তিতে একমত হন।
ইইউ কমিশনারের বার্তা ও মাছ প্রক্রিয়াকরণে অগ্রগতি
ইইউ-ভারত এফটিএকে “ব্যবসায়িকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ” আখ্যা দিয়ে কমিশনার মারোশ শেফচোভিচ বলেন—শুল্ক ও অ-শুল্ক বাধা কমলে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও সাপ্লাই চেইন আরও শক্তিশালী হবে এবং উন্মুক্ত, নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক বাণিজ্য সুরক্ষিত থাকবে। ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ইইউ সম্প্রতি ভারতের ১০২টি নতুন মৎস্যপ্রতিষ্ঠানকে সি-ফুড রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে।
ইএফটিএ ও যুক্তরাজ্য: দুই চুক্তির অগ্রগতি
ইউরোপীয় ফ্রি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন (ইএফটিএ)—যার অর্থনীতি প্রায় ১.৪১ ট্রিলিয়ন ডলার—এর সঙ্গে ভারতের এফটিএ কার্যকর। যুক্তরাজ্যের (প্রায় ৩.৬৩ ট্রিলিয়ন ডলার) সঙ্গে চুক্তিও বাস্তবায়নের পথে। দুটি চুক্তিই কার্যকর হলে এবং ইইউ-এফটিএ সম্পন্ন হলে ইউরোপীয় বাজারে ভারতের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হবে।
শুল্কমুক্ত সুবিধা: ভারতের জন্য কী বদলাবে
জিরো-ডিউটি প্রবেশাধিকার ইউরোপে ভারতীয় পণ্যের দামে সরাসরি সুবিধা দেবে, ফলে ভারতীয় পণ্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় বেশি প্রতিযোগিতামূলক হবে। তৈরি পোশাক খাতের মতে—যুক্তরাজ্য, ইএফটিএ ও সম্ভাব্য ইইউ চুক্তি একত্রে ইউরোপে ভারতের রপ্তানি প্রায় ২.৫ গুণ বাড়াতে পারে; বর্তমানে যা প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্কের প্রভাব ও বিকল্প বাজার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্কের চাপ ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ইইউ-সহ ইউরোপজুড়ে শুল্কমুক্তির সুযোগ বাড়লে সেই চাপ আংশিকভাবে প্রশমিত হবে। যদিও এফটিএগুলো মার্কিন শুল্কের প্রভাব পুরোপুরি অফসেট করবে না, তবে এগুলো ভারতের প্রযুক্তি, প্রতিযোগিতা ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সক্ষমতা বাড়াবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো নন-এফটিএ বাজারে শুল্কঝুঁকি সামাল দিতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়েও নভেম্বরে অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
শিল্পখাতের মতামত
• অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিল (এইপিসি) বলছে, ইউরোপীয় বাজারে ভারতের প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কড়া শুল্কের প্রভাব কমবে।
• ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশন্স (এফআইইও) মনে করে, এফটিএগুলো ভারতের রপ্তানি সক্ষমতা, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর বাড়াবে।
• ইওয়াই ইন্ডিয়া-র ট্রেড পলিসি বিশেষজ্ঞ অগ্নেশ্বর সেন বলেন—শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ইউরোপে দামে বড় সুবিধা দেবে, তবে মানদণ্ড ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মেনে চলতে শিল্পকে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
• প্রিমাস পার্টনার্সের প্রধান নির্বাহী নিলয় বর্মা মনে করেন, ইউরোপকেন্দ্রিক এফটিএগুলো রপ্তানি-বৈচিত্র্য জোরদার করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের প্রভাব আংশিক কমাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে এখনও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজার—বিশেষত ফার্মাসিউটিক্যালস, ইঞ্জিনিয়ারিং, রত্ন ও গহনা, টেক্সটাইলস, অটো কম্পোনেন্টস ও আইটি সেবায়।
রেগুলেটরি মানদণ্ড: ইউরোপে সফলতার চাবিকাঠি
ইউরোপের বাজারে সুযোগ যেমন বড়, তেমনি মান ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধিনিষেধও কঠোর। তাই শুল্কমুক্ত সুবিধার পূর্ণ ব্যবহার করতে হলে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের টেকসই উৎপাদন, ট্রেসেবিলিটি, পণ্যনিরাপত্তা, পরিবেশমান ও শ্রমমানের ইউরোপীয় মানদণ্ড মেনে চলতে হবে। এই খাতে বিনিয়োগই এখন সময়ের দাবি।
ভারত-ইইউ বাণিজ্যের সাম্প্রতিক চিত্র
২০২৪–২৫ অর্থবছরে ভারত-ইইউ পণ্যবাণিজ্যের আকার ছিল প্রায় ১৩৬.৫৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ইইউ-তে ভারতের রপ্তানি প্রায় ৭৫.৮৫ বিলিয়ন ডলার এবং ইইউ থেকে আমদানি প্রায় ৬০.৬৮ বিলিয়ন ডলার। ইইউ ভারতের বৃহত্তম পণ্যবাণিজ্য অংশীদার, আর ২০২৩ সালে সেবা-বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ভারতের মোট রপ্তানির ১৭% যায় ইইউতে; বিপরীতে, ইইউর ৯% রপ্তানি যায় ভারতীয় বাজারে।
ইএফটিএ ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এফটিএ কার্যকর হওয়া এবং ইইউর সঙ্গে আলোচনার সফল সমাপ্তি ভারতের জন্য এক ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করবে। শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার রপ্তানিতে মূল্যসুবিধা দেবে, বাণিজ্য-বৈচিত্র্য বাড়াবে এবং যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক ঝুঁকি কমাবে। তবে এই সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার নির্ভর করবে ইউরোপীয় মানদণ্ড মেনে রপ্তানি সক্ষমতা উন্নয়নের ওপর—যেটাই ভারতের ভবিষ্যৎ বিজয়রূপরেখা নির্ধারণ করবে।
#ভারতইইউ #মুক্তবাণিজ্যচুক্তি #শুল্কমুক্তপ্রবেশাধিকার #ভারতেররপ্তানি #ইউরোপীয়বাজার #এফটিএ #অর্থনীতি #সারাক্ষণরিপোর্ট