সুশাসন, বিনিয়োগ ও অর্থনীতির অনিশ্চয়তা
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক দীর্ঘশ্বাসের পথে হাঁটছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষা করছেন স্থিতিশীল রাজনীতির জন্য, আর দেশের ব্যবসায়ীরা তাকিয়ে আছেন নীতিনির্ধারকদের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে।
মূল্যস্ফীতি, ঋণ সংকট ও সুদের হার বৃদ্ধির চাপ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। সরকার ব্যয়সংকোচন নীতি বজায় রাখার কথা বললেও বাজারে পণ্যমূল্যের অস্থিরতা ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপ অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলছে।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে কিছুটা আলো দেখা গেলেও সামগ্রিক চিত্রে মন্দাভাব থেকেই যাচ্ছে—যেন এক ভারী, নিঃশব্দ ক্লান্তি পুরো অর্থনীতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
প্রবৃদ্ধির মন্থরতা ও আস্থার সংকট
বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চাপ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, এবং আর্থিক খাতের দুর্বলতা মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৭৬ শতাংশে—যা গত এক দশকের মধ্যে অন্যতম নিম্নস্তর।
এই ধীরগতি কেবল সংখ্যার পরিবর্তন নয়, এর ছায়া পড়েছে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের ওপরও। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি উদ্যোক্তাদের নতুন প্রকল্পে আগ্রহ কমিয়েছে, ফলে উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনীতির প্রকৃত ক্ষতি হচ্ছে “আস্থা হারানো”—যখন বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত, তখন প্রবৃদ্ধির যেকোন পূর্বাভাস কেবল কাগজে সীমিত থাকে।
ব্যাংক খাতের সংকট ও সংস্কারের পথ
ব্যাংক খাত এখন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা। মার্চ ২০২৫ নাগাদ খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৪.১ শতাংশে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের প্রায় তিন গুণ বেশি। মূলধনঝুঁকি অনুপাত নেমে এসেছে ৬.৩ শতাংশে, যা ন্যূনতম নিয়ন্ত্রক মান (১০%) এর অনেক নিচে।
এই বাস্তবতায় সরকার ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ জারি করেছে—যার লক্ষ্য দুর্বল ব্যাংক পুনর্গঠন, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার ও আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি তারল্য সহায়তা (ইএলএ) চালু করেছে, যাতে সাময়িক সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় সহায়তা পায়।
তবুও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—সংস্কারের ভাষণ কি বাস্তবে কার্যকর হতে পারবে?
রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে আশার আলো
অর্থনীতির সবচেয়ে স্থিতিশীল দুই স্তম্ভ—রপ্তানি ও রেমিট্যান্স—এই কঠিন সময়েও আশার আলো জ্বেলে রেখেছে।
২০২৫ সালের প্রথমার্ধে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮.৮ শতাংশ, যার নেতৃত্বে রয়েছে তৈরি পোশাক, চামড়া, কৃষিপণ্য ও প্লাস্টিক খাত। একই সময়ে প্রবাসী আয় বেড়েছে ২৬.৮ শতাংশ, যা ইতিহাসে অন্যতম সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি।
এই দুটি খাতের ইতিবাচক প্রভাবে চলতি হিসাব আট বছর পর প্রথমবারের মতো উদ্বৃত্ত হয়েছে, প্রায় ১৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, “এই দুই খাতই এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রকৃত রক্ষাকবচ।”
শিল্প, কৃষি ও শ্রমবাজারে দুরবস্থা
কৃষি খাত বছরের শেষে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও শিল্প ও নির্মাণ খাত স্থবির। সেবা খাতেও মন্দাভাব, বিশেষ করে পরিবহন, বাণিজ্য ও আবাসন খাতে কর্মসংস্থান কমেছে।
২০২৪ সালে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৬০.৯ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ৫৮.৯ শতাংশে। নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় মোট কর্মসংস্থান অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৫৬.৭ শতাংশ, এবং বেকারত্ব বেড়ে ৩.৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানের এই সংকট আরও গভীর হবে, যা সামাজিক ভারসাম্যেও প্রভাব ফেলবে।
রাজস্ব ঘাটতি ও বাজেটের ভার
কর আদায় জিডিপির অনুপাতে কমে হয়েছে ৬.৮ শতাংশ, যা আগের বছরের ৭.৪ শতাংশ থেকে কম। অন্যদিকে ভর্তুকি ও সুদের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.২ শতাংশ, উন্নয়ন ব্যয় কমে এসেছে ৩.৩ শতাংশে।
ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৭ শতাংশ জিডিপি। সরকার করনীতি সংস্কারে পদক্ষেপ নিচ্ছে—যেমন কর প্রশাসনের পৃথকীকরণ, কর অব্যাহতি সীমিতকরণ, এবং অনলাইন রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা।
কিন্তু সরকারি ঋণ ক্রমশ ভারী হচ্ছে, যার ৩৭ শতাংশ দেশীয় ব্যাংকব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, “এই প্রবণতা বিপজ্জনক, কারণ এতে সরকারি ঋণ বেসরকারি বিনিয়োগের জায়গা দখল করে নিচ্ছে।”
আগামী পথ: সংস্কার, স্থিতিশীলতা ও সুশাসন
বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা একমত—বাংলাদেশের পুনরুদ্ধারের চাবিকাঠি হলো নীতিগত স্থিতিশীলতা ও কার্যকর সংস্কার।
ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা, রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি না পেলে অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়বে।
একইসঙ্গে মানবসম্পদের উন্নয়ন, শিক্ষা ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের প্রসার এখন সময়ের দাবি। সুশাসন ছাড়া কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের সাফল্য আশার আলো জ্বালাচ্ছে, অন্যদিকে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও রাজস্ব ঘাটতি সেই আলোকে ম্লান করে দিচ্ছে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজন আস্থা ফিরিয়ে আনা—বিনিয়োগকারীদের মনে, সাধারণ মানুষের জীবনে, আর রাষ্ট্রের নীতিতে। কারণ অর্থনীতির সঠিক দিকনির্দেশ তখনই সম্ভব, যখন দেশ একসঙ্গে বিশ্বাস করতে পারে যে ভবিষ্যৎ এখনও সম্ভব।
#বাংলাদেশঅর্থনীতি #মন্দা #ব্যাংকসংকট #রেমিট্যান্স #রপ্তানি #রাজস্বঘাটতি #সুশাসন #সংস্কার #সারাক্ষণ