যুক্তরাষ্ট্র যখন তাদের বিদ্যুৎচালিত গাড়ি (ইভি) উদ্যোগ থেকে সরে আসছে, সেই একই ধারা এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইভি লক্ষ্য অর্জনের সময়সীমা পরিবর্তন বা স্থগিত করেছে। গাড়ি উৎপাদকরা বলছে, উচ্চ ব্যাটারি খরচ, অনির্ভরযোগ্য চার্জিং অবকাঠামো এবং সরকারিভাবে প্রণোদনা হ্রাস—এসবই এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছড়িয়ে পড়া সংকেত
- • জেনারেল মোটরস মঙ্গলবার জানিয়েছে, তারা ১.৬ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি দেখাবে—ইভি বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে। কোম্পানিটি বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইভি প্রণোদনা ও নিয়ন্ত্রক বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়েছে, যা তাদের জন্য বড় ধাক্কা।
- • “গণমানুষের এই পরিবর্তন এত দ্রুত হচ্ছে না, সেটা বোঝা যাচ্ছে,” বলেন ম্যাককিনসি অ্যান্ড কো-র পার্টনার প্যাট্রিক শাউফুস।
- • নিসান আমেরিকার চেয়ারম্যান ক্রিশ্চিয়ান মেনিয়ের বলেন, “ইভি হয়তো ভবিষ্যতের সমাধান, কিন্তু তা গ্রাহকদের গলায় জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।”
ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে সঙ্কট ও সমন্বয়
- • ফক্সওয়াগন ঘোষণা করেছে, তারা ৩৫,০০০ জনকে চাকরি থেকে বাদ দেবে—যা ইউরোপের রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোড়ন তুলেছে।
- • ইউরোপীয় কমিশন ইভি নির্মাতাদের সঙ্গে একটি “কৌশলগত সংলাপ” শুরু করেছে এবং ২০২৫ সালের নির্ধারিত নির্গমন নীতিতে সময় বাড়িয়েছে।
- • ইউরোপীয় শিল্প কমিশনার স্তেফান সেজুরনে জানিয়েছেন, ২০৩৫ সালের শূন্য-কার্বন লক্ষ্য যত দ্রুত সম্ভব পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।
- • মিউনিখ অটো শোতে স্টেলান্টিসের ইউরোপীয় প্রধান জ্যাঁ-ফিলিপ ইমপারাতো বলেছিলেন, ২০৩০ ও ২০৩৫ সালের লক্ষ্য বাস্তবসম্মত নয়।
- • ফক্সওয়াগন প্রধান অলিভার ব্লুম বলেন, “প্রস্তুত অবকাঠামো, সস্তা বিদ্যুৎ ও প্রণোদনা ছাড়া শিল্পকে নাজুক অবস্থায় ফেলা যাবে না।”
কানাডা: উদ্যম থেকে বাস্তবতায়
- • কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনি আগামী বছর ইভি বিক্রির বাধ্যতামূলক শর্ত বহাল রাখার পরিকল্পনা বাতিল করেছেন।
- • তিনি বলেন, “আমরা অটোমোবাইল শিল্পে এক নতুন পুনর্গঠনের শুরুতে আছি,” এবং ২০২৬ সালের ইভি ম্যান্ডেট স্থগিত রেখে অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
- • কারনি জানিয়েছেন, সরকার ইভি নীতি পুনর্বিবেচনা করবে এবং খরচ কমিয়ে আরও সাশ্রয়ী ইভি বাজারে আনার পদক্ষেপ নেবে।
চীন ও জাপান: বিপরীত পথে
- • বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইভি বাজার চীনে বিক্রি বাড়লেও মুনাফা কমে এসেছে। অ্যালিক্সপার্টনার্স সংস্থা জানিয়েছে, ২০২৩ সালে চালু ১১৮টি ইভি ব্র্যান্ডের অধিকাংশই আগামী পাঁচ বছরে টিকে থাকতে পারবে না।
- • জাপান, যেখানে প্রযুক্তিগত নির্ভরতার চাপ তুলনামূলক কম, সেখানে হাইব্রিড গাড়িকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
- • টয়োটা বরাবরই ইভির তুলনায় হাইব্রিড প্রযুক্তিতে জোর দিয়েছে, কারণ তাদের ধারণা, সম্পূর্ণ ইভি-নির্ভরতা এখনো বাস্তবসম্ভব নয়।
যুক্তরাষ্ট্র: পরিকল্পনা স্থবির
- • সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রে ইভি বিক্রি প্রত্যাশার নিচে নেমে গেছে।
- • কংগ্রেস ও প্রশাসনের বড় পরিবর্তনগুলো হলো—
• ইভি ক্রেতাদের জন্য ৭,৫০০ ডলারের কর-ছাড় বাতিল
• ফেডারেল জ্বালানি দায়বদ্ধতা মানদণ্ড ও জরিমানার নীতি তুলে নেওয়া
• ক্যালিফোর্নিয়ার নিজস্ব নির্গমন মান নির্ধারণের ক্ষমতা বাতিল করা - • অ্যালিক্সপার্টনার্সের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন যানবাহনের মাত্র ১৮% হবে ইলেকট্রিক—যা আগের পূর্বাভাসের অর্ধেক।
চ্যালেঞ্জ ও প্রশ্ন
- • গাড়ি নির্মাতারা বলছেন, ইভি ব্যবসা এখনো লাভজনক নয়।
- • ব্যাটারি খরচ, অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা ও সরকারি প্রণোদনার ঘাটতি—এসবই বড় প্রতিবন্ধক।
- • বিশেষ করে চীনের কম খরচের ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র এখন ঝুঁকিতে পড়েছে।
- • যুক্তরাষ্ট্র যদি তার পরিবেশ-উদ্যোগ ছেড়ে দেয়, তাহলে দেশটি শূন্য-কার্বন ও নবায়নযোগ্য অর্থনীতিতে চীনের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইভি নীতিতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তার প্রতিধ্বনি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বজুড়ে। উচ্চ খরচ, অবকাঠামোর অসামঞ্জস্যতা এবং সরকারিভাবে প্রণোদনা প্রত্যাহার—সব মিলিয়ে এই উল্টো যাত্রার পেছনের মূল কারণ। বর্তমানে গাড়ি শিল্প বাজার ও সরকারের নীতির পুনর্মূল্যায়নের মুখে। ভবিষ্যতে ইভি উদ্ভাবন ও গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করবে সরকার, শিল্প ও বাজারের সমন্বিত বাস্তববাদিতার ওপর।
#ইলেকট্রিকগাড়ি #যুক্তরাষ্ট্র #বিশ্ববাজার #অর্থনীতি #গাড়িশিল্প #EVpolicy #সারাক্ষণরিপোর্ট