যে অস্থির হৃদয় একসময় কৌতূহল, রহস্য আর অফুরন্ত কল্পনায় ধুকপুক করত, তার হঠাৎ থেমে যাওয়া শুধু শোকই রেখে যায় না—যেখানে কিশোরবেলার নস্টালজিয়া মিশে থাকত মধুর বিষণ্নতায়, সেখানে কেটে দেয় এক আরোগ্যহীন ক্ষত।
এই বুধবার, টিন গয়েন্দা সিরিজের শ্রদ্ধেয় লেখক রকিব হাসান ডায়ালাইসিস চলাকালে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চিকিৎসার জন্য তিনি বহুবার ফিরেছিলেন—প্রতিবারের ফেরা ছিল তাঁর আলো জিইয়ে রাখার নরম সুতো। কিন্তু এবার চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নিল, রেখে গেল আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি।
রহস্যের পিছু ধাওয়ার নিয়তি
রকিব হাসান ১৯৫০ সালের ১২ ডিসেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবার বদলির চাকরির কারণে শৈশব কেটেছে ফেনীসহ নানা জেলায়; তবে তিনি নিজের ভেতর বয়ে বেড়াতেন আরেকটা জগৎ—ছায়া, ধাঁধা আর বিস্ময়ে ভরা এক অন্তর্লোক।
প্রথমদিকে পড়াশোনা শেষে কিছুদিন নিরুত্তাপ নিয়মিত চাকরিও করেছেন। কিন্তু সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৬টার জীবন কোনোদিনই মানাত না এমন এক আত্মাকে, যার নিয়তি ছিল অজানার পথে ঘুরে বেড়ানো, সাসপেন্সের খোঁজে বের হওয়া, আর বলে ফেলার অপেক্ষায় থাকা ঘটনাকথাগুলোর পিছু ধাওয়া করা।
কিছু বই কেবল গল্প বলে না—ওগুলো ব্যাগে লুকিয়ে থাকে, ডেস্কের কোনা থেকে উঁকি দেয়, মোটা পাঠ্যবইয়ের পাতার ভাঁজে ঢুকে পড়ে, শীতের কম্বলের নিচে হয়ে ওঠে সঙ্গী, বাইরে দুপুর যখন অতিরিক্ত কোলাহলময় হয়ে ওঠে তখন হয়ে ওঠে তোমার গোপন বন্ধু। নব্বই ও দুই হাজার দশকে যাদের বড় হওয়া, তাদের বহুজনের কাছে ‘টিন গয়েন্দা’ ছিল ঠিক তেমনই।
১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল সিরিজটির; কিন্তু সেটা কখনোই শুধু গোয়েন্দা কাহিনি ছিল না। রবার্ট আর্থার জুনিয়রের ‘দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ থেকে প্রাথমিক অনুপ্রেরণা নিয়ে রকিব হাসান অস্থির কিশোর হৃদয়ের জন্য গড়ে তুলেছিলেন এক স্বতন্ত্র জগৎ।
কিশোর, মুসা আর রবিন—চাঁদের আলোয় প্রতিধ্বনিত হাসি, অন্ধকার বনে টিমটিমে সাহস, ছায়াময় করিডোরে কেঁপে ওঠা সংশয়—সব মিলিয়ে তারা হয়ে উঠেছিল আমাদের অদৃশ্য সঙ্গী। তারা ছিল আমাদের ফিসফিসে আকাঙ্ক্ষা, ন্যায়ের স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস। তাদের অভিযাত্রার ভেতর দিয়ে আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছিলাম—রহস্যের সমাধান সম্ভব, সত্য উন্মোচিত হয়, আর বন্ধুত্ব যে কোনো ভয়কে জয় করতে পারে।
আর ছিলেন জর্জিনা ‘জিনা’ পার্কার—দুরন্ত, দুষ্টুমি-ভরা, নির্ভীক। তিনি মুসাকে টিজ করতেন, ছেলেদের চ্যালেঞ্জ দিতেন, আবার উষ্ণতা আর আনুগত্যে দলটাকে একসূতোয় বেঁধে রাখতেন। আমাদের কিশোর বয়সের কাছে তিনি শুধু চরিত্র নন—রাতের হাসি, কল্পনার স্ফুলিঙ্গ, সেই দুঃসাহসী সত্তা; বিছানার পাশে ম্লান ল্যাম্পের আলোয় ‘টিন গয়েন্দা’র পাতা উল্টানো মানেই ছিল তখন এক অচেনা জগতে নিঃশব্দে ঢুকে পড়া—যার ভেতরকার মানে তখনও পুরো বোঝা হয়নি।
এখনও যখন কোনো হলদে হয়ে যাওয়া, পিঠে ভাঁজ ধরা বই হাতে নিই, বুকের ভেতর হালকা নস্টালজিয়া কেঁপে ওঠে—হারানো কৈশোর যেন আবার বেঁচে ওঠে রকিব হাসানের রেখে যাওয়া অভিযাত্রায়। ৪০০–র বেশি বই—যার মধ্যে ১৫০–রও বেশি ‘টিন গয়েন্দা’—ছিল তাঁর উপহার। আমাদের বহুজনের কাছে সেই বইগুলো এমনসব জগৎ, যা কখনো ম্লান হয় না।
‘টিন গয়েন্দা’র বাইরেও
বলাই বাহুল্য, তাঁর কল্পনার ছিল না কোনো সীমানা। নিজের নামে লেখার পাশাপাশি ‘রোমহর্ষক’ সিরিজে ‘জাফর চৌধুরী’ ছদ্মনামে, আর ‘গোয়েন্দা রাজু’তে ‘আবু সাইয়ীদ’ নামে লিখেছেন। ‘টারজান’, ‘আরব্য রজনী’সহ চিরকালীন বহু রোমাঞ্চ তিনি অনুবাদও করেছেন—দূরদেশের জগতগুলোকে তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশের কিশোরদের হাতে।
তাঁর লেখা নিছক রহস্যভেদের গল্প ছিল না—ছিল সাহস, স্থিতি আর নীরব বীরত্বের পাঠ; যা তরুণ পাঠকের চিন্তাজগৎ গড়ে তুলতে জাদুর মতো কাজ করেছে। প্রতিটি কাহিনিতে ছিল শৈশব রাতের বুকধড়ফড়, আবিষ্কারের উত্তেজনা, অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সাহসের ফিসফাস—যা মনে করিয়ে দিত, অন্ধকারের ভেতরেও মূল্যবান কিছু অপেক্ষা করে।
এখন সেই কণ্ঠস্বর থেমে গেছে—শিশুর ঘুমপাড়ানি গল্পের শেষ কোমল প্রতিধ্বনির মতো মিলিয়ে।
ভক্তদের জন্য এখন কী রইল? কয়েকটি বিবর্ণ পাতা, ভালোবাসায় ক্ষয়ে যাওয়া মলাট, প্রান্তে কিশোরবেলায় লেখা হাতের লেখা—যেগুলো আর আগের মতো বেপরোয়া নয়। পুরোনো মশারির নিচে, মরতে-থাকা হলুদ বাতির কাঁপা আলোয় পড়া সেই বইগুলোয় ছিল বৃষ্টি–কাদা–ধুলোর গন্ধ, আর ছিল একসঙ্গে থাকার সত্যিকারের বন্ধুত্ব। আর সেই পঙ্ক্তিগুলোর ফাঁকে কোথাও একটি প্রজন্ম খুঁজে পেয়েছিল নিজের সাহস, নিজের হাসি, দীর্ঘজীবী হওয়া ও বড় স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে।
টিন গয়েন্দা, গোয়েন্দা রাজু, রোমহর্ষক—যে নামগুলো একসময় প্রতিধ্বনিত হতো সকালের স্কুলপ্রাঙ্গণ থেকে বিকেলের খেলাঘর পর্যন্ত—এখন তারা বুকশেলফে নীরব ভূতের মতো শুয়ে থাকে; ফিসফিসিয়ে জানায় এমন এক জগতের প্রতিশ্রুতি, যা আর ফিরে আসবে না।
ছোট ছোট পকেটবইগুলো আমাদের সামনে খুলে ধরেছিল একদম নতুন জগৎ—বোঝাতেও শিখিয়েছিল। তারা শেখায়—রহস্য কেবল জঙ্গল বা কুয়াশায় নয়; বড় হয়ে ওঠার ব্যথায়, জাদু হারানোর ভয়েও লুকিয়ে থাকে—আর সেই একগুঁয়ে আশাতেও যে আমাদের নায়কেরা কখনও মারা যায় না।
তবু তারা যায়—রকিব হাসানের মতোই। তিনি আমাদের রেখে যান স্মৃতির আধো-আলো করিডোরে ভবঘুরে হয়ে হাঁটতে—তাঁর লেখাগুলোকে টিমটিমে মশালের মতো আঁকড়ে ধরে, যা গল্পকার চলে যাওয়ার পরও জ্বলে থাকে।
শেষ বিদায়
মনে পড়ে—কম্বলের নিচে লুকিয়ে ‘টিন গয়েন্দা’ পড়ছি; মা জেনে ফেলবেন এই ভয়ে বুক ধুকপুক করছে; রাত পার হয়ে গেছে—তবু আরেকটা অধ্যায়, আরেকটু! মনে পড়ে, কেউ যখন জিজ্ঞেস করত, “কে সমাধান করল?”, তখন গর্বে বলতাম—যেন আমিও ছিলাম ওই অভিযানের একজন।
চোখ ভিজলেও কৃতজ্ঞতা রয়ে যায়—তাঁর হাসির মুহূর্তগুলোর জন্য, ভয় জয়ের কৌশলের জন্য, ধাঁধার জন্য, আর তাঁর শব্দের সঙ্গে কাটানো অসংখ্য রাতের জন্য। এই বোঝাপড়ার জন্য—শিশুরাও যে মহৎ গল্প পাওয়ার যোগ্য, আর সাধারণ জীবনেও যে অসাধারণ বিস্ময় লুকিয়ে থাকে।
বিদায়, রকিব হাসান। আপনি চলে গেছেন, কিন্তু আপনার রহস্যগুলো রয়ে গেছে—আমাদের ধুলো-মাখা বুকশেলফে, ব্যথাতুর হৃদয়ে, আর অজানার খোঁজে বেরোনো প্রতিটি তরুণ–তরুণীর ভেতরে—যারা আপনার শব্দ পড়তে পড়তেই বড় হয়েছে।
আপনার পবিত্র আত্মা শান্তি পাক!
আর আপনার লেখার আবেদন যেন কখনও ম্লান না হয়!