দক্ষিণ কোরিয়ায় বাছাইকৃত মানবাধিকার নিয়ে ভণ্ডামি এখন স্পষ্ট। বর্তমানে দেশজুড়ে জাতিগত চীনা জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে বর্ণবাদী, চীনবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। অথচ কয়েক সপ্তাহ আগেই যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি অভিবাসী আটককেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০০ দক্ষিণ কোরিয়ানকে মুক্ত করা হয়—যা অধিকাংশ কোরিয়ানের দৃষ্টিতে মানবিক মর্যাদাবিরোধী ও অন্যায্য আটক ছিল।
দুটি ঘটনার পারস্পরিক যোগসূত্র সরাসরি না থাকলেও, একসঙ্গে রাখলে এগুলো আমাদের দেশে বিদেশি নাগরিকদের প্রতি জটিল সম্পর্ককে নগ্ন করে—যেখানে মানবিক মর্যাদা কেবল “আমাদের” জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, “ওদের” জন্য নয়।
জর্জিয়ায় আইসিইর অভিযান
৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) জর্জিয়ায় হিউন্দাই–এলজি ব্যাটারি প্ল্যান্টে হানা দিয়ে ৪৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করে—যাদের বেশিরভাগই দক্ষিণ কোরিয়ান। একক স্থানে অভিবাসনবিরোধী এটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধরপাকড়। আইসিই অভিযোগ করে, অনেক আটক ব্যক্তি ভিসা বা ভিজিটর স্ট্যাটাসের শর্ত লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে কাজ করছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং এই অভিযানকে “আমাদের মানুষের ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপ” বলে অভিহিত করেন।
কোরিয়ান গণমাধ্যম আইসিই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষ ও অমানবিক আচরণের অভিযোগ তোলে। ধাতব শিকলে হাত–পা বাঁধা কোরিয়ানদের ছবি ভাইরাল হয়। দেশের অন্যতম বড় সম্প্রচারমাধ্যম ওয়াইটিএনের এক ক্ষুব্ধ ভাষ্যকার বলেন, “দক্ষিণ কোরিয়ানদের কি এভাবে অপমান করা যায়, আফ্রিকা থেকে আনা দাসদের মতো আচরণ করা যায়?”
এই ক্ষোভের ভেতরে ছিল এক ধরনের বিস্ময়—“এটা আমাদের সঙ্গে হলো কীভাবে?” সব মিলিয়ে, দক্ষিণ কোরিয়া উন্নত দেশ, নামমাত্র জিডিপিতে বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলোর একটি। কে-পপ ও কে-বিউটিকে ভর করে তার সফট-পাওয়ার ব্র্যান্ড লাভজনক। একই গ্রীষ্মে যখন নেটফ্লিক্সে সবচেয়ে দেখা শিরোনাম “কে-পপ ডেমন হান্টারস” ভাইরাল হয়, তখনই দেশের শীর্ষ করপোরেশনের কর্মীদের হাত–পা শিকল পরানো হলো—এটাই বা কীভাবে সম্ভব?
১২ সেপ্টেম্বর জর্জিয়া থেকে কোরিয়ানরা ফিরে এলে ইনচন বিমানবন্দরে হাসি–কান্নায় ভাসে আবেগঘন পুনর্মিলন। এরপর থেকে অনেক কোরিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জবাবদিহি ও বিচার দাবি করছেন।
আলোচনায় অনুপস্থিতরা
এই বিতর্কে প্রায় অনুপস্থিত রয়ে গেলেন জর্জিয়ায় তখনও আটক প্রায় ২০০ জন অ–কোরিয়ান।
ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দেয়—মানবাধিকারের ভিত্তি কতটা ভঙ্গুর। সভ্যতা আর বর্বরতার মাঝের রেখাটি অতিক্রম করা ভাবনার চেয়েও সহজ। আমরা প্রত্যেকেই কোথাও না কোথাও বিদেশি; আমাদের মৌলিক মর্যাদা সর্বত্রই শ্রদ্ধার দাবি রাখে। কিন্তু এই উপলব্ধি কি দক্ষিণ কোরিয়ার নিজস্ব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিও প্রসারিত হয়? বিদেশে কোরিয়ানদের প্রতি অবিচার কি আমাদের দেশে বিদেশি নিবাসীদের প্রতি আচরণ পুনর্বিবেচনার অনুঘটক হতে পারে?
এখন পর্যন্ত ছবিটা আশাব্যঞ্জক নয়।
ভিসা মওকুফ ও বিক্ষোভের জোয়ার
কোরিয়ানদের জর্জিয়া থেকে মুক্তির কয়েক সপ্তাহ পর, ২৯ সেপ্টেম্বর সম্পূর্ণ পৃথক নীতিগত পদক্ষেপ হিসেবে প্রেসিডেন্ট লি সাময়িক ভিসা মওকুফ প্রবর্তন করেন—যে ব্যবস্থায় অন্তত আগামী জুন পর্যন্ত চীন থেকে গ্রুপ পর্যটকদের দক্ষিণ কোরিয়ায় আসা সহজ হয়। অর্থনীতি চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে নেওয়া এই পদক্ষেপ বিক্ষোভ ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বন্যা বইয়ে দেয়।
“চায়না আউট! ওই ‘জি…’ কমিউনিস্টরা বের হয়ে যাও!”—রাস্তায় গর্জে ওঠেন বিক্ষোভকারীরা, যাদের অধিকাংশকে চরম ডানপন্থি হিসেবে ধারণা করা হয়। ‘জি…’ শব্দটি জাতিগত চীনা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত অবমাননাকর গালি। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের প্রথমভাগ জুড়ে সিউলকেন্দ্রিক হলেও অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে—হাজারে হাজারে, হয়তো লাখ ছুঁই–ছুঁই—চীনবিরোধী বর্ণবাদী বিক্ষোভ। অনলাইনে ভুয়া খবরের সয়লাব—চীনাদের ‘কমিউনিস্ট গুপ্তচর’, ‘ধর্ষক’, ‘শিশু হত্যাকারী’ ইত্যাদি বলে চিত্রিত করা হচ্ছে।
চীনা বংশোদ্ভূত স্থানীয়দের ভয়ের আবহ
সিউলের দেরিমদং এলাকার মতো পাড়ায়—যেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক–চতুর্থাংশ চীনা (রাজধানীর বাকি অংশে গড়ে প্রায় ২%)—ভয় বিশেষ করে তীব্র।
একটি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক—যেখানে প্রায় ৬০% শিক্ষার্থী চীনা বংশোদ্ভূত বলে জানা যায়—জেলা পুলিশকে চিঠি লিখে সতর্ক করেন যে, এসব বিক্ষোভ শিক্ষার্থীদের ওপর মারাত্মক মানসিক আঘাত করতে পারে। বিক্ষোভ বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে তিনি লেখেন, “ঘৃণামূলক বিক্ষোভ আমাদের সংবিধানে নিশ্চিত মানব মর্যাদার পরিপন্থী। এগুলো বিস্তার লাভ করলে পুরো সমাজের নিরাপত্তা ও সমতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।”
জনমিতি, প্রবাসী ও সংখ্যার রাজনীতি
দক্ষিণ কোরিয়া এখনো বড় পরিসরে জাতিগতভাবে সমজাতীয়; ৫ কোটি ১৭ লাখের জনসংখ্যার প্রায় ৫% নিবন্ধিত বিদেশি। চীনা নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ, দেশজুড়ে বিচিত্র কমিউনিটিতে তাঁদের বসতি।
কিন্তু কোরিয়ায় তাঁদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, বিশ্বপর্যায়ে চীনা শক্তির উত্থানও তেমন দৃশ্যমান; তেমনি বাড়ছে চীনভীতি। সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ ২০২২ সালের এক জরিপে দেখায়, ৮১% কোরিয়ান উত্তরদাতা চীনের প্রতি নেতিবাচক বা খুব নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। ইন্দো–প্যাসিফিক জুড়ে জরিপকৃত ১৫টি দেশের মধ্যে চীনের প্রতি সবচেয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দক্ষিণ কোরিয়ায়।
“‘চীনকে ঘৃণা করি’ নিঃসন্দেহে আমাদের সময়ের চেতনায় জায়গা করে নিয়েছে”—এমন শিরোনামে কোরিয়ান সাময়িকী সিসাইন ২০২২ সালে একটি দেশকেন্দ্রিক জরিপ চালিয়ে দেখায়, চীনবিরোধী মনোভাব দলীয় আনুগত্য বা অর্থনৈতিক অবস্থান ছাপিয়ে গেছে। বিস্ময়করভাবে, অধিকাংশ কোরিয়ান চীনের প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন উত্তর কোরিয়ার চেয়েও বেশি।
ভীতি কতটা বোধগম্য, কতটা বিপজ্জনক
কোনো কোনো মাত্রায় চীনভীতি যুক্তিসঙ্গতও বটে। অঞ্চলের বহু দেশের মতো দক্ষিণ কোরিয়াও ক্রমেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই বৃহৎ বাণিজ্যসঙ্গীর—ক্ষমতার টানাপড়েনে আটকা পড়ছে। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়ান ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করলে বেইজিং পাল্টা প্রতিশোধ নেয়—ভ্রমণ, ব্যবসা, সংস্কৃতি–পণ্যে বিধিনিষেধ আরোপ করে। কোরিয়ার এক্সপোর্ট–ইমপোর্ট ব্যাংকের অধীন ওভারসিজ ইকোনমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট অনুমান করে, এতে দেশের ক্ষতি হয়েছে সর্বোচ্চ ১৬ ট্রিলিয়ন উন (প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার)।
তবে কোরিয়ান প্রেক্ষাপটে এই চীনভীতি জটিল হয়েছে উত্তর কোরিয়াকে ঘিরে দীর্ঘদিনের ‘কমিউনিস্ট আতঙ্ক’—বাস্তব ও কল্পিত—দিয়ে; তাতে যোগ হয়েছে চরম ডানপন্থি ষড়যন্ত্রতত্ত্বের জট।
রাজনীতি, অভিশংসন ও ঘৃণাবাক্য
বর্তমান চীনবিরোধী বিক্ষোভকারীদের বড় অংশই ইউন সোক ইয়লের দৃঢ় সমর্থক; তিনি গত এপ্রিলে অভিশংসিত হন, চার মাস আগে সংবিধানবিরোধীভাবে সামরিক আইন জারির পর। তাঁদের বিশ্বাস, সদ্য নির্বাচিত লি জে মিয়ং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণের ষড়যন্ত্র করছেন।
“সবচেয়ে ভালো ‘জি…’ হলো মৃত ‘জি…’”—এ রকম ঘৃণাবাক্য ২০১৮ সাল থেকেই অনলাইনে ঘুরছে। বাক্যটি শিউরে ওঠার মতো—জর্জিয়ায় শিকলে বাঁধা কোরিয়ানদের ছবির স্মৃতি উসকে দেয়; কারণ এমন উক্তি মানুষকে মানবিকতা থেকে বঞ্চিত করে, রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে ব্যঙ্গচিত্রে নামিয়ে আনে। ভাবনার চেয়ে শিগগিরই এমন বাক্য কাজে রূপ নিতে পারে।
চীনাদের গণ্ডি ছাড়িয়ে—বর্ণবাদী বাস্তবতা
লক্ষ্যভিত্তিক এই বর্ণবাদ কেবল চীনা অভিবাসীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি দক্ষিণ কোরিয়ায় বিদেশিদের—বিশেষ করে রঙিন চামড়ার মানুষের—উপর বিস্তৃত মনোভাবের ক্ষুদ্রচিত্র। কয়েক মাস আগে এক শ্রীলঙ্কান কারখানাশ্রমিককে ফর্কলিফটে বেঁধে প্লাস্টিক মোড়কে জড়িয়ে রাখা হয়—অভিযোগ, ‘অদক্ষতার শাস্তি’ হিসেবে কোরিয়ান সহকর্মীরা তাঁকে এমন নির্যাতন করেন। কর্মীটির বয়স ছিল ৩১ বছর। কর্মী–অধিকারকর্মীরা যে ভিডিও প্রকাশ করেন, তাতে পেছনে হাসির শব্দ শোনা যায়।
বৈষম্যবিরোধী আইনহীনতা
দক্ষিণ কোরিয়ায় এখনো বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সুরক্ষাদানকারী কোনো আইন নেই—যদিও ২০০০–এর দশকের শুরু থেকে প্রগতিশীল কর্মীরা বৈষম্যবিরোধী আইনের নানা খসড়া প্রস্তাব করে আসছেন।
প্রতিসংস্কৃতি: প্রতিরোধের আওয়াজ
বর্তমান চীনবিরোধী বিক্ষোভের জবাবে নাগরিকগোষ্ঠী, গণমাধ্যম ও রাজনীতির ভেতর থেকে জোরালো ও প্রতিবাদী কথোপকথন উঠছে—বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সতর্ক সংকেত বাজাচ্ছে।
“দাঁড়িয়ে থাকো, দেরিমদং! ঘৃণার বিরুদ্ধে আমরা একসাথে!”—এক পাল্টাবিক্ষোভে কোরিয়ানদের স্লোগান। “বৈষম্য শুধু অভিবাসীদের ওপর আক্রমণ নয়; এটি আমাদের ভবিষ্যতের ওপর আক্রমণ। আমাদের সন্তানদের যে পৃথিবীতে বাস করতে হবে, সেখানে অভিবাসী ও বিদেশিদের সঙ্গে সহাবস্থান অপরিহার্য। আমরা সবাই মিলে সেই পৃথিবী রক্ষায় লড়ব।”
লেখক পরিচিতি: হেরিউন কাং সিউলভিত্তিক সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র “নারোর মহাকাশ সন্ধান”-এর পরিচালক।