মালয়েশিয়া স্কুলে সহিংসতা ও অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে বেত্রাঘাত পুনরায় চালু করা, স্মার্টফোন নিষিদ্ধ করা এবং ১৬ বছরের নিচে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা আরোপের কথা বিবেচনা করছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকটের মূলে রয়েছে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ, প্রাপ্তবয়স্কদের অবহেলা ও দুর্বল শিক্ষা–পরিচালনা ব্যবস্থা।
সাম্প্রতিক ঘটনার পটভূমি
গত কয়েক মাসে দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতার একাধিক ঘটনা জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে মেলাকায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, কেদাহে ধর্ষণ মামলার ভিডিও ফাঁস, এবং ১৪ অক্টোবর সেলাঙ্গরে ১৬ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত। এসব ঘটনার পর থেকেই সরকার নতুন শৃঙ্খলাবিধি ও আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়।
সরকারের প্রস্তাব ও পদক্ষেপ
প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম ১৭ অক্টোবর বলেছেন, “শিক্ষকদের কঠোর নিয়মাবলির আওতায় শাস্তিমূলক বেত্রাঘাতের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।” তিনি জোর দেন, শাস্তি দিতে হবে ‘সহানুভূতি ও যত্নের ভারসাম্যে’। একই দিন মন্ত্রিসভা প্রস্তাব দেয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ন্যূনতম বয়স ১৩ থেকে বাড়িয়ে ১৬ বছর করা হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, স্কুলে বেত্রাঘাত আইনত অনুমোদিত থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা প্রায় বন্ধ। অন্যদিকে, ২০১৮ সালের এক সার্কুলারে স্মার্টফোন স্কুলে আনার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, ট্যাব বা ল্যাপটপ অনুমোদিত।
নাগরিক সমাজ ও শিশু অধিকারকর্মীদের আপত্তি
শিশু অধিকারকর্মী হার্তিনি জায়নুদ্দিনের মতে, “স্মার্টফোন নিষেধাজ্ঞা বা বেত্রাঘাত পুনরুজ্জীবন কোনোভাবেই গভীর সহিংসতা বা হতাশা কমায় না।” তিনি বলেন, “সহিংসতার উৎস প্রযুক্তি নয় — বরং প্রাপ্তবয়স্কদের অবহেলা ও ব্যবস্থাগত ব্যর্থতা।”
তরুণ সংগঠন Initiate.my-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা আইজাত শামসুদ্দিন বলেন, “শাস্তি হয়তো সাময়িক ভীতি তৈরি করে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মানসিক কষ্টের মূল কারণ সমাধান করে না।” তাঁর মতে, দেশের স্কুল কাউন্সেলিং ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত, ফলে প্রাথমিক মানসিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
গবেষকদের বিশ্লেষণ
কুয়ালালামপুরের থিংক-ট্যাঙ্ক ইমান রিসার্চের গবেষক আজিফ আজুদ্দিন বলেন, “বেত্রাঘাত বা ফোন নিষেধাজ্ঞা সহজ সমাধান মনে হলেও এগুলো মূল সমস্যাকে স্পর্শ করে না।” তাঁর মতে, “শিশুরা এখন অনিয়ন্ত্রিত অনলাইন কনটেন্টে প্রবেশ করছে — শিক্ষা থেকে শুরু করে চরমপন্থী উপাদান পর্যন্ত। সরকারকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।”
নতুন উদ্যোগ ও শিক্ষানীতির পরিবর্তন
শিক্ষামন্ত্রী ফাদলিনা সিদেক ৩ মিলিয়ন রিঙ্গিত বরাদ্দ ঘোষণা করেছেন, যা দিয়ে ২০০টি স্কুলে সিসিটিভি স্থাপন এবং অতিরিক্ত কাউন্সেলর নিয়োগ করা হবে। পাশাপাশি ২০২৭ সালের পাঠ্যসূচিতে ‘চারিত্রিক শিক্ষা’ (Character Education) নামের নতুন একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে, যার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হবে ২০২৬ সালে।
সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষতিকর কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণেও নতুন নীতি প্রণয়নের কথা জানিয়েছে।
মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ও মতবিরোধ
সেলাঙ্গরের এক শিক্ষক জানান, “আমাদের স্কুলে এক হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী। প্রতিদিনের স্পট-চেক সময়সাপেক্ষ হলেও নিরাপত্তার স্বার্থে এটি প্রয়োজনীয়।” তিনি বেত্রাঘাত পুনর্বহালের পক্ষে মত দিয়ে বলেন, “এটি বহু পুরোনো, কার্যকরী একটি পদ্ধতি — আমি শিক্ষক এবং অভিভাবক, দুই দিক থেকেই তা অনুভব করি।”
অন্যদিকে অভিভাবক সংগঠন Parent Action Group for Education–এর চেয়ারপারসন নূর আজিমাহ আবদুল রাহিম বলেন, “অনেক অভিভাবক বুঝতে পারেন না, অনলাইন বিনোদনমূলক ভিডিওতেও লিঙ্গবৈষম্য বা সহিংস ধারণা লুকানো থাকে।”
শিক্ষার্থীদের কণ্ঠ
শিক্ষার্থী অধিকারকর্মী আইন হুসনিজা সাইফুল নিজাম, যিনি ২০২১ সালে শিক্ষক কর্তৃক ধর্ষণ–রসিকতা ফাঁস করে আলোড়ন তুলেছিলেন, বলেন, “স্কুলে সহিংসতার দায় শুধু শিশুদের নয় — বরং প্রাপ্তবয়স্করা নিরাপদ ও শ্রদ্ধাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।”
তাঁর ভাষায়, “সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে দায় দেওয়া বা বেত্রাঘাত ফিরিয়ে আনা মানে পুরোনো ক্ষতের ওপর শুধু ব্যান্ডেজ লাগানো।”
মালয়েশিয়া বর্তমানে কঠোর শৃঙ্খলা ও সহানুভূতির মধ্যে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য খুঁজছে। শিশুদের নিরাপত্তা, মানসিক সুস্থতা ও শিক্ষা–পরিবেশে শৃঙ্খলা বজায় রাখার এই লড়াই এখনও চলমান — এবং সহজ কোনো সমাধান আপাতত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
#
মালয়েশিয়া,# শিক্ষা, #সহিংসতা,# বেত্রাঘাত,# শিক্ষানীতি, #শিশু অধিকার, #সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, #সারাক্ষণ রিপোর্ট