চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার একটি গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে ৫০ লাখ টাকা তোলা হলেও বাস্তবে কোনো কাজ হয়নি। স্থানীয়দের অভিযোগ, টাকাটি তুলে নেওয়া হয়েছে কালভার্ট নির্মাণ ছাড়াই। এ ঘটনায় এলাকায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এবং দুর্নীতির অভিযোগে প্রশাসনিক তদন্ত শুরু হয়েছে।
প্রকল্পের বিবরণ
রাগই গ্রামের সূচিপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় একটি ১২ মিটার দীর্ঘ কালভার্ট নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সরকারি নথি অনুযায়ী, পুরো প্রকল্পের বাজেট ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার বেশি, যার একটি অংশ থাপাদারবাড়ি খালপাড়া এলাকায় কালভার্ট নির্মাণের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
এই কাজের দায়িত্ব পান ঠিকাদার তাজুল ইসলাম সুমন। কিন্তু সাইট প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও নির্মাণকাজ শুরুই হয়নি। ২০২৫ সালের মে মাসে ঠিকাদার ৫০ লাখ টাকা—অর্থাৎ প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক অর্থ—তুলে নেন কোনো কাজ না করেই।
অনিয়মের সূত্র ও প্রশাসনিক নথি
এই অনিয়মের বিষয়টি প্রকাশ পায় গত ২৯ মে তারিখের উপজেলা উন্নয়ন অগ্রগতি প্রতিবেদনে। নথিটি তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা এবং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. সবুজের স্বাক্ষরিত বলে জানা গেছে। এদের দুজনকেই পরবর্তীতে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে।
বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিয়া হোসেন অভিযোগটি স্বীকার করে বলেন, “ঠিকাদার কাজ না করেই ৫০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। তদন্ত চলছে, ফলাফলের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মশিউন উদ্দিনও বলেন, “কাজ সম্পন্ন না করে বিল উত্তোলনের প্রমাণ মিললে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে কালভার্ট নির্মাণ নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”
স্থানীয়দের ক্ষোভ ও ভোগান্তি
স্থানীয়দের জন্য এই কালভার্ট শুধু একটি অবকাঠামো নয়—এটি তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। ২০১৭ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সেতু ও কালভার্টগুলো আজও মেরামত না হওয়ায় চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
রাগই গ্রামের বাসিন্দা আবু সাঈদ বলেন, “ঠিকাদার কাজ শুরুই করেননি। বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর শুধু কিছু পাথর ফেলে রেখেছেন।”
আরেক বাসিন্দা মজিবুর রহমান জানান, “এই কালভার্ট আমাদের জন্য খুব জরুরি। বর্ষায় চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।”
সালেহা বেগম ও মরিয়ম নেছা বলেন, “শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা বাজার—সবকিছুতেই দূরে যেতে হয়। এই কালভার্ট হলে জীবনে অনেক সহজ হতো।”
ঠিকাদারের ব্যাখ্যা
যোগাযোগ করা হলে ঠিকাদার তাজুল ইসলাম সুমন বলেন, “স্থানে পানি থাকার কারণে কাজ শুরু করতে পারিনি।”
তবে কীভাবে কাজ শুরু না করেই ৫০ লাখ টাকা তোলা হলো—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলুন।”
প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপ
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিয়া হোসেন জানিয়েছেন, নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় করে প্রকল্পটি পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মশিউন উদ্দিন বলেন, “যারা সরকারি অর্থের অপব্যবহার করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি কালভার্ট নির্মাণ দ্রুত নিশ্চিত করা হবে।”
চাঁদপুরের এই প্রকল্পটি গ্রামীণ উন্নয়ন উদ্যোগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তাকে আবারও সামনে এনেছে। সরকারি বরাদ্দের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত না হলে শুধু অর্থ অপচয়ই নয়, সাধারণ মানুষের জীবনও কঠিন হয়ে পড়ে—রাগই গ্রামের কালভার্ট প্রকল্প তারই একটি প্রতিচ্ছবি।