গাজায় হামাসের গুলিতে দুই সেনা নিহতের পর রবিবার ইসরায়েল নতুন করে বিমান ও ট্যাংক হামলা চালায় এবং জানায়, তারা ওই অঞ্চলে মানবিক সহায়তা প্রবাহ বন্ধ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া চলতি যুদ্ধবিরতির মধ্যে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুতর সংকট।
গাজায় নতুন করে হামলা ও হতাহত
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাতে জানা যায়, ইসরায়েলি বিমান ও ট্যাংক হামলায় অন্তত ১৮ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন নারীও রয়েছেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা হামাসের ঘাঁটি, সুরঙ্গ, অস্ত্রাগার ও কয়েকজন ফিল্ড কমান্ডারের অবস্থানে হামলা চালিয়েছে, কারণ হামাস যোদ্ধারা অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল ছুড়ে দুই সেনাকে হত্যা করেছিল।
নুসেইরাত এলাকায় বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত একটি স্কুলেও এক দফা হামলা হয়, বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি রক্ষায় হামাসের অবস্থান
হামাসের সামরিক শাখা জানায়, তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে অটল আছে, এবং রাফাহ এলাকায় সংঘর্ষের বিষয়ে অবগত নয়। তারা মার্চ মাসের পর থেকে স্থানীয় অন্য কোনো গ্রুপের সঙ্গেও যোগাযোগে নেই।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, হামাস যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে, এবং তিনি সেনাবাহিনীকে ‘জোরালো জবাব’ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
শান্তির পথে অনিশ্চয়তা
ইসরায়েলের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানান, হামাসের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের কারণে গাজায় সহায়তা সরবরাহ ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত’ বন্ধ থাকবে।
তবে ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানিয়েছে: যুক্তরাষ্ট্রের চাপে সোমবার সকাল থেকে আবারও সহায়তা প্রবাহ শুরু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক Axios সংবাদমাধ্যমের বরাতে বলা হয়, ইসরায়েল ওয়াশিংটনকে জানিয়েছে, তারা সোমবার একটি ক্রসিং পুনরায় খুলবে।
যুদ্ধবিরতি ভেঙে যেতে পারে—এই আশঙ্কায় নুসেইরাতের বাজারে মানুষ খাদ্যসামগ্রী মজুদ করতে ছুটে যায়। খান ইউনিসের পরিবারগুলোও ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে শুরু করে, কারণ আশপাশে হামলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
পূর্বের ঘটনার পুনরাবৃত্তি
২০২৪ সালের শেষ দিকে ইসরায়েল–হিজবুল্লাহ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় পারস্পরিক হামলার মতো ঘটনাও ঘটে। এবারও পরিস্থিতি অনেকটা সেই রকমই, যদিও তখনকার যুদ্ধবিরতি শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল।
এর আগেও মার্চ মাসে গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে গিয়েছিল, যখন প্রায় দুই মাসের শান্তির পর ইসরায়েল ব্যাপক বিমান হামলা চালায়।
জিম্মিদের মৃতদেহ ফেরত নিয়ে বিতর্ক
১০ অক্টোবর নতুন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল ও হামাস একে অপরকে শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত করছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ ঘোষণা দিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির সীমারেখা বা ‘ইয়েলো লাইন’ স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হবে এবং সেই সীমা অতিক্রম করলে ‘গুলি চালানো হবে’।
হামাস দাবি করেছে, ইসরায়েলই একাধিক লঙ্ঘনের মাধ্যমে ৪৬ জনকে হত্যা করেছে, এবং মানবিক সহায়তা বন্ধ রেখেছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল বলেছে, হামাস খুব ধীরে জিম্মিদের মৃতদেহ হস্তান্তর করছে। গত সপ্তাহে হামাস জীবিত ২০ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয় এবং এরপর ২৮ জন মৃতদেহের মধ্যে ১২টি হস্তান্তর করেছে।
রাফাহ ক্রসিং ও সহায়তা স্থবিরতা
রাফাহ সীমান্ত, যা গাজা ও মিশরকে যুক্ত করে, মে ২০২৪ থেকে কার্যত বন্ধ রয়েছে। ইসরায়েল জানিয়েছে, হামাস চুক্তির শর্ত পূরণ না করা পর্যন্ত সীমান্তটি খোলা হবে না।
চলতি যুদ্ধবিরতি অনুযায়ী গাজায় মানবিক সহায়তা বাড়ানোর কথা ছিল, কারণ আগস্ট মাসে আইপিসি (IPC) গ্লোবাল ক্ষুধা মনিটরের তথ্যমতে, সেখানে লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে ছিল।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির শুরু থেকে সহায়তা প্রবাহ কিছুটা বেড়েছিল, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম।
এখনো অমীমাংসিত প্রশ্ন
গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের রোডম্যাপ, সবই এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
ইসরায়েলি হামলায় নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে এমন এক সময়—যখন যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ হলে অঞ্চলজুড়ে আরও বড় সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মানবিক সহায়তা বন্ধ এবং সীমান্ত বন্ধের ফলে গাজার মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়ছে, আর শান্তির পথ ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
#ট্যাগ: #গাজা, #ইসরায়েল,# হামাস, #যুদ্ধবিরতি, #মধ্যপ্রাচ্য, #মানবিক সংকট, #রাফাহ সীমান্ত, #সারাক্ষণ রিপোর্ট