ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ‘ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি’ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন আইনি কাঠামো দিয়েছে। রুশ বিশ্লেষক আদলান মারগোয়েভ বলেন, এটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়, বরং ভবিষ্যৎ সহযোগিতার নমনীয় ভিত্তি তৈরি করেছে, যা উভয় দেশের স্বার্থ ও কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হবে।
জাতিসংঘে নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের প্রশ্নে রাশিয়ার অবস্থান
রুশ বিশেষজ্ঞ মারগোয়েভের মতে, ইরানের ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের পশ্চিমা উদ্যোগ ‘আইনগতভাবে অবৈধ ও অবৈধতা-নির্ভর’। তাঁর যুক্তি—যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই পরমাণু চুক্তি (জেসিপিওএ) থেকে সরে দাঁড়িয়েছে এবং ইউরোপও তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে, ওই দেশগুলোর ‘স্ন্যাপব্যাক’ প্রক্রিয়া চালুর কোনো বৈধতা নেই। রাশিয়ার দৃষ্টিতে এটি একতরফা চাপ প্রয়োগের কৌশল, যা আন্তর্জাতিক পরমাণু অপ্রসারণ নীতির পরিপন্থী।
রাশিয়ার বিরোধিতার পেছনে তিনটি কারণ
মারগোয়েভ বলেন, রাশিয়া তিনটি কারণে এই ‘স্ন্যাপব্যাক’ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করছে—
১. রাশিয়া ‘পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি’ (এনপিটি)-এর আমানতকারী রাষ্ট্র হিসেবে আইনি ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের পক্ষে। একতরফা নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক হুমকি এই লক্ষ্যকে দুর্বল করে।
২. ইরান রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদার। পশ্চিমা চাপের মুখে তেহরানকে রক্ষা করা মস্কোর কূটনৈতিক দায়বদ্ধতা।
৩. পুনর্বহাল করতে চাওয়া জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞাগুলো মূলত পারমাণবিক ও সামরিক সহযোগিতার সঙ্গে সম্পর্কিত—যা দুই দেশের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
নতুন চুক্তির প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য
মারগোয়েভ বলেন, এই নতুন কৌশলগত চুক্তির লক্ষ্য হলো ২০০১ সালের আগের চুক্তির আইনি ভিত্তি হালনাগাদ করা এবং বর্তমান সহযোগিতার পরিধি বাড়ানো। তবে এটি কোনো পারস্পরিক সামরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি নয়। কোনো তৃতীয় পক্ষ আক্রমণ করলে এক দেশ অন্য দেশের হয়ে যুদ্ধ করবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। বরং তারা আগ্রাসীর সহায়তা না করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পারস্পরিক সহায়তার উপায় বিবেচনা করবে।
ইউরেশিয়ায় নতুন ভারসাম্যের ইঙ্গিত
চুক্তিটি ইরান–রাশিয়া সম্পর্ককে কেবল সামরিক নয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নতুন মাত্রা দিয়েছে। উভয় দেশই বহুমুখী বিশ্ব ব্যবস্থায় নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চাইছে, যেখানে একতরফা জোটের পরিবর্তে নমনীয় কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রাধান্য পাচ্ছে।
পশ্চিমা চাপের মুখে ইরানের কূটনৈতিক অবস্থান
ইরানের দীর্ঘদিনের নীতি ছিল “না পূর্ব, না পশ্চিম”—অর্থাৎ কোনো শক্তিশালী ব্লকের অধীনে না থাকা। কিন্তু পশ্চিমা অবরোধ ও চাপে পড়ে তেহরান পূর্বমুখী নীতি গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। এখন তারা চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করছে, যা এসসিও ও ব্রিকস সদস্যপদেও প্রতিফলিত হয়েছে।
মারগোয়েভ বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের স্বার্থ উপেক্ষা করছে, তাদের ওপর পরমাণু কর্মসূচি বন্ধের জন্য চাপ দিচ্ছে এবং প্রকৃত কূটনীতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে ইরানের কাছে পূর্বের সঙ্গে সহযোগিতাই একমাত্র বাস্তব বিকল্প হিসেবে রয়ে গেছে।
অন্যান্য আঞ্চলিক দেশের জন্য বার্তা
বিশ্লেষক মনে করেন, ইরান–রাশিয়ার এই চুক্তি পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য দেশকেও অনুপ্রাণিত করতে পারে। বর্তমানে সৌদি আরব–পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, এমনকি ন্যাটো সদস্য তুরস্কও বহুমুখী কৌশলগত কূটনীতির পথ বেছে নিচ্ছে। এটি শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী একক জোটব্যবস্থার পরিবর্তে বহুমাত্রিক অংশীদারিত্বের যুগের সূচনা নির্দেশ করছে।
ইরান–রাশিয়ার এই চুক্তি তাই কেবল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতিফলন নয়; এটি বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে নতুন বাস্তবতা ও বহুমেরু বিশ্বের আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠার দিকেও এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।