রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে সিআইডি কনস্টেবলের ওপর সাম্প্রতিক হামলা যেন প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশের ক্রমবর্ধমান অনিরাপত্তা ও মানসিক ভাঙনের। ১৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞের ধারায় বহু পুলিশ নিহত বা আহত হয়েছে—আর সরকারের দেওয়া দায়মুক্তি নীতি যেন তাদের আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তাকে মাটিচাপা দিচ্ছে।
১৮ জুলাইয়ের পর থেকে হত্যাযজ্ঞ ও ভয়াবহ ধারাবাহিকতা
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই ছিল পুলিশের জন্য এক দুঃস্বপ্নের সূচনা। সেদিন ঢাকায় টহলরত পুলিশের ওপর সশস্ত্র হামলায় দুই সদস্য নিহত হন। এরপর টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজধানীসহ সারাদেশে ঘটে একের পর এক হামলা।
বিশেষ করে আগস্টের ৪, ৫ ও ৬ তারিখে হামলার ঘনঘটায় একাধিক থানার সদস্য নিহত ও আহত হন। এক সিনিয়র কর্মকর্তা স্মরণ করে বলেন, “১৮ জুলাইয়ের পর দিন গোনা নয়, মৃতের সংখ্যা গোনা শুরু হয়েছিল।”
সরকারের দায়মুক্তি ও মনোবল ভাঙনের সূত্র
এ ধারাবাহিক হামলার পর কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সরকার “বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায়” তাদের দায়মুক্তি দেয়। সরকার বলেছিল, এটি “অবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধান”। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তই পুলিশের মনোবলে সবচেয়ে বড় আঘাত হয়ে আসে।
এক কনস্টেবল বলেন, “আমরা দেখেছি যারা সহকর্মী হত্যা করেছে, তারাই আবার রাস্তায় ঘুরছে। আমরা তাহলে কিসের জন্য জীবন দিচ্ছি?”
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই দায়মুক্তি সংস্কৃতি পুলিশ সদস্যদের মনে গভীর বিশ্বাসঘাতকতার (institutional betrayal) অনুভূতি তৈরি করেছে। তারা এখন বাহ্যিক নিরাপত্তার পাশাপাশি নিজেদের পেশাগত মর্যাদা নিয়েও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
ভয় ও অনিশ্চয়তার ভেতর দায়িত্ব পালন
যাত্রাবাড়ীর হামলাটি সেই ভয়েরই প্রতিফলন। ভোরের আলো ফোটার আগেই এক পুলিশ সদস্য ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত হন, আর হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। স্থানীয়দের সহযোগিতায় আহত রাসেল মিয়াকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
তার সহকর্মীরা বলছেন, “প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও আমাদের ওপর হামলা হচ্ছে। জানি না, পরের টার্গেট কে।”
এই পরিস্থিতিতে টহল বা রুটিন দায়িত্বে থাকা সদস্যদের মানসিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে। কেউ এখন রাতে একা দায়িত্ব নিতে ভয় পান, আবার কেউ পরিবারকে নিজের কাজের ঝুঁকি বোঝাতে পারেন না।
দায়মুক্তির নীতির পরিণতি
সরকারের এই দায়মুক্তি নীতির কারণে হামলাকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে—এমন অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। হামলার পরও যদি বিচার না হয়, অপরাধীরা তা উৎসাহ হিসেবে নেয়।
এক সাবেক আইজিপি মন্তব্য করেন, “দায়মুক্তি মানে অপরাধের বৈধতা দেওয়া। এতে আইনের শাসন ভেঙে পড়ে, আর পুলিশের মনোবল ধসে পড়ে।”
মানসিক দৃঢ়তা ও ভেতরের লড়াই
তবু অনেক পুলিশ সদস্য এখনও দায়িত্বে অবিচল। ভয়, হতাশা ও অবিশ্বাসের মধ্যেও তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এক উপ-পরিদর্শক বলেন, “আমরা ভয় পাই, কিন্তু থামি না। এই ইউনিফর্ম এখন কেবল চাকরির প্রতীক নয়—এটি বিশ্বাস রক্ষার প্রতিশ্রুতি।”
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মানসিক চাপ কাটাতে পুলিশের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং, ট্রমা পুনর্বাসন ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা কার্যক্রম এখন জরুরি।
১৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞে বহু পুলিশ নিহত, আহত এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। সরকারের দায়মুক্তি নীতি কেবল বিচারপ্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়নি, বরং পুলিশের মনে ভয় ও অবিশ্বাসের গভীর বীজ বপন করেছে।
আজকের যাত্রাবাড়ীর হামলা সেই ভাঙনেরই প্রতিচ্ছবি—একটি সমাজে, যেখানে আইনরক্ষকই নিরাপদ নয়। রাষ্ট্র যদি দ্রুত দায়মুক্তির এই সংস্কৃতি বন্ধ না করে, তবে পুলিশের মানসিক দৃঢ়তা হারিয়ে যাবে, আর সেই সঙ্গে দুর্বল হয়ে পড়বে দেশের আইনশৃঙ্খলার শেষ স্তম্ভটিও।
#: পুলিশ_মনোবল, দায়মুক্তি_নীতি, যাত্রাবাড়ী_হামলা, মানসিক_দৃঢ়তা, আইনশৃঙ্খলা, সারাক্ষণ_রিপোর্ট