সপ্তাহখানেক আগে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধবিরতি নতুন সহিংসতায় নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। সপ্তাহান্তের রক্তক্ষয়ী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারীরা ইসরায়েল ও হামাসকে আলোচনায় ফেরাতে সোমবার নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখতে এবং পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপ শুরু করতে সক্রিয় কূটনৈতিক চাপ দিচ্ছে।
সহিংসতার পর যুদ্ধবিরতিতে টানাপোড়েন
রবিবারের হামলায় দুই ইসরায়েলি সেনা নিহত হওয়ার পর ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়। এই সহিংসতা যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপেই বড় ধাক্কা দিয়েছে। যদিও দুই পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির প্রতি অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে, তবে ক্রমাগত সংঘর্ষের কারণে পরিস্থিতি অস্থির হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকদের মতে, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং গাজার ভবিষ্যৎ প্রশাসন—এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো অনিষ্পন্ন থাকায় স্থায়ী শান্তি এখনো অনিশ্চিত।
ট্রাম্পের ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্য’ পরিকল্পনা
দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে অর্জিত প্রধান কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসন এই যুদ্ধবিরতিকে ধরে রাখতে চায়। সোমবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “হামাস চুক্তিভঙ্গ করেছে, তবে নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের কারণেই এটি ঘটেছে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “যদি তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনে, প্রয়োজনে আমরা তাদের নিশ্চিহ্ন করব,” যদিও তিনি পরিষ্কার করেছেন যে, মার্কিন সেনা এতে অংশ নেবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মিশন ও আলোচনার পরবর্তী ধাপ
ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ দূত স্টিভ উইটকফ ও জামাতা জ্যারেড কুশনার সোমবার তেলআবিবে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য যুদ্ধবিরতি পুনরায় স্থিতিশীল করা ও ২০ ধাপের পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে আলোচনা শুরু করা।
মঙ্গলবার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও ইসরায়েল সফর করবেন। নেতানিয়াহু জানিয়েছেন, তারা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সুযোগ নিয়ে আলোচনা করবেন।
এই সফরের পাশাপাশি সোমবার মিশরের কায়রোতেও হামাস নেতাদের সঙ্গে মার্কিন আলোচনার প্রস্তুতি চলছে। ট্রাম্প এই সমঝোতাকে “নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক ভোর” হিসেবে অভিহিত করেছেন।
গাজায় নতুন হতাহতের ঘটনা ও বিভ্রান্তি
ফিলিস্তিনি চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সোমবার “হলুদ রেখা”-র কাছে ইসরায়েলি ট্যাংকের গোলায় আরও তিনজন নিহত হয়েছেন। এই রেখাটি গাজার জনবহুল এলাকা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর প্রথম পর্যায়ের প্রত্যাহার সীমারেখা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনারা জানায়, ওই এলাকায় অনুপ্রবেশকারীদের লক্ষ্য করে তারা গুলি চালিয়েছে। তবে গাজার অনেক বাসিন্দা সীমারেখার অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্ত, কারণ তা দৃশ্যমান নয়।
এক বাসিন্দা সামির বলেন, “সব জায়গা ধ্বংসস্তূপে পরিণত, মানচিত্রে রেখা দেখা গেলেও বাস্তবে কোথায় তা বোঝা যাচ্ছে না।”
জিম্মিদের মরদেহ হস্তান্তর ও হামাসের আলোচনার প্রস্তাব
সপ্তাহান্তের সহিংসতার আগে নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ীই উইটকফ ও কুশনারের সফর হয়। এদিকে সোমবার হামাস এক জিম্মির মরদেহ রেড ক্রসের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ফেরত দিয়েছে। ইসরায়েল বিশ্বাস করে, আরও পাঁচজনের মরদেহ দ্রুত ফেরত পাওয়া যেতে পারে, তবে গাজার ধ্বংসস্তূপের কারণে বাকি দেহ উদ্ধার কঠিন হবে।
মিশর সোমবার কায়রোতে হামাস নেতা খালিল আল-হাইয়ার সঙ্গে বৈঠক আয়োজন করেছে। আলোচনায় গাজায় হামাসবিহীন একটি প্রযুক্তিগত প্রশাসন গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হতে পারে বলে জানা গেছে। তবে হামাস ও তার মিত্র সংগঠনগুলো বিদেশি প্রশাসনের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অস্ত্র সমর্পণের আহ্বানও নাকচ করেছে, যা চুক্তি বাস্তবায়নে জটিলতা বাড়াতে পারে।
সহিংসতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা
ইসরায়েল জানিয়েছে, রাফাহ এলাকায় চুক্তিভুক্ত সীমার মধ্যে দুই সেনা নিহত হওয়ার ঘটনার পর তারা পাল্টা হামলা চালিয়েছে। হামাস দাবি করেছে, ঐ অঞ্চলে তাদের কোনো কার্যক্রম নেই এবং স্থানীয় গ্রুপগুলোর সঙ্গে মার্চের পর থেকে কোনো যোগাযোগও হয়নি।
হামাস আরও অভিযোগ করেছে, ইসরায়েল একাধিকবার যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ৪৬ জনকে হত্যা করেছে এবং প্রয়োজনীয় সরবরাহ বন্ধ করেছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “হলুদ রেখার বাইরে কোনো হামাস যোদ্ধা দেখা গেলে তাকে কোনো সতর্কতা ছাড়াই লক্ষ্যবস্তু করা হবে।”
গাজা যুদ্ধবিরতি এখন এক অনিশ্চিত ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাম্প প্রশাসন শান্তি ধরে রাখতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তবে মাটিতে সহিংসতা এবং রাজনৈতিক অবিশ্বাসের কারণে স্থায়ী সমাধান এখনো অধরা।