চীনের শহরগুলোতে স্বয়ংক্রিয় রোবোভ্যান এখন আর ভবিষ্যতের কল্পনা নয়—বরং বাস্তব রাস্তায় চলছে পরীক্ষামূলকভাবে। পরিবহন দক্ষতা বাড়াতে, খরচ কমাতে এবং প্রযুক্তিনির্ভর ডেলিভারি ব্যবস্থাকে উন্নত করতে দেশটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। তবুও স্বয়ংক্রিয় ডেলিভারির পথে রয়ে গেছে প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক কিছু বড় চ্যালেঞ্জ।
রাশ আওয়ার পর আরম্ভ কর্ম
শেনঝেনে রাত আটটা নাগাদ যখন রাশ আওয়ারের চাপ কিছুটা কমে আসে, সেখানকার SF Express-এর স্টোরেজ সুবিধা থেকে একাধিক স্বয়ংক্রিয় রোবোভ্যান চালু হয়। এসব যানবাহন একটি নির্ধারিত রুট ধরে চলতে থাকে—পার্সেল নিয়ে স্টোরেজ এলাকা থেকে রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের কাছে সংযোগ স্থলে এসে থামে। মানুষ যেন দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখে, সেই বিষয়টি তাদের গোলমাল শব্দে সতর্ক করা হয়—আর যদি যাত্রী পায়ে এগিয়ে আসে, তাহলে ভ্যান থেমে যায়।
প্রতিটি ভ্যানে প্রায় তিন ঘনমিটার কার্গো ধারণক্ষমতা রয়েছে এবং সর্বোচ্চ পাঁচশো কিলোগ্রাম পর্যন্ত পার্সেল বহন করতে সক্ষম। স্টোরেজ থেকে পার্সেল আনলোড হয় এবং সেগুলো মেট্রো ট্রেনে স্থানান্তরিত হয়, যা পরে বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছায়। এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য হলো সিটি মেট্রোর খালি থাকা জায়গাগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা।
রোবোভ্যানে চীনের অগ্রগতি
চীন রোবোভ্যানে দ্রুত এগিয়ে চলছে। রোবোভ্যান নির্মাতা নিলিক্স (Neolix) জানিয়েছে, তারা ইতিমধ্যে দশ হাজারটি স্বয়ংক্রিয় যানবাহন মোতায়েন করেছে—যা এই ক্ষেত্রে এক অনন্য সাফল্য।
নিলিক্সের নির্বাহী সভাপতি উইল ঝাও বলেছেন, আগামী দশ বছরের মধ্যে এই সংখ্যা এক কোটিতে পৌঁছাতে পারে। “অ্যালগরিদম যেদিন আরও উন্নত হবে, যেদিন যানবাহন দ্রুত চালাতে পারবে, সেদিন মানব চালক আর সামনে থাকবে না”—এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তিনি।
খরচ কম ও কর্মক্ষমতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি
রোবোভ্যানে যাত্রী নেই—তাই এটি খরচ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে রোবোট্যাক্সির তুলনায় সহজ। চালক কেবিন, এয়ারকন্ডিশনার বা অডিও প্লেয়ার ছাড়াই ভ্যান চালানো হয়। ঝাও বলছেন, “এই ভ্যান ইতিমধ্যে একটি বাণিজ্যিক গাড়ির তুলনায় বিশ থেকে ত্রিশ শতাংশ সস্তা।”
চীনের বড় বড় ডেলিভারি কোম্পানিগুলো প্রতিদিন কোটি কোটি পার্সেল পরিবহন করছে। এসব নিয়ে খরচ কার্যকর করতে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।
স্থানীয় ব্যবহারে সরকার ও প্রবণতা
চীনের স্থানীয় সরকারের সক্রিয় ভূমিকার কারণে এসব রোবোভ্যানের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। দুই হাজার একুশ সালে বেইজিং শহর নিলিক্সকে প্রথম রোবোভ্যান অনুমোদন দেয়। এছাড়া শান্ডং প্রদেশের কিংডাওতে গত বছর আটটি জেলার একশো একুশটি রাস্তায় ট্রায়াল চালু হয়েছে। এ বছর শেনজেনে বিভিন্ন জেলার মধ্য দিয়ে চলার রুটেও অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
নিলিক্স ডেলিভারি কোম্পানিগুলোকে ভ্যান বিক্রি ও লিজিংয়ের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে। তারা রাইড-হেইলিং কোম্পানি Didi Chuxing-এর সঙ্গেও অংশীদারিত্ব করেছে।
চ্যালেঞ্জ এখনও কাটেনি
রোবোভ্যানে দ্রুততা এখনও সীমিত—মেট্রো স্টেশনের ভিতরও হাঁটার গতি থেকে সামান্য দ্রুত এগোয়। মালপত্র সাজানো, পার্সেল গঠন বা সরাসরি গ্রাহকের দরজায় পৌঁছে দেওয়া—এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো এখনও পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় হয়নি। হাইওয়েতে ঘুরিয়ে নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া নিয়েও সরকারের দিক থেকে শঙ্কা রয়েছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও প্রতিযোগিতা
ওয়াল স্ট্রিট ইনভেস্টরদের নজর পড়েছে এই সেক্টরে। নিলিক্স চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একশো কোটি ইয়ুয়ান (প্রায় একশো চল্লিশ মিলিয়ন ডলার) তুলেছে। আগামী বছর হংকংয়ে আইপিও দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।
চীনের ভিতরে নিলিক্সের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন জিলোস্টেক (Zelostech) ইতিমধ্যে একশো মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিলিক্স দক্ষিণ কোরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ট্রায়াল পরিচালনার পরিকল্পনা করছে। বছরের শেষ নাগাদ বিদেশ থেকে এক হাজারের বেশি রোবোভ্যান অর্ডার পাওয়ার আশা করছে কোম্পানিটি।
নিলিক্সের বিশ্বাস, চীনের বিশাল বাজার, প্রযুক্তি গ্রহণের আগ্রহ এবং সরকারের সহায়ক নীতিমালাই তাদের অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রাখছে।
চীনে রোবোভ্যানে দ্রুত উন্নতি ঘটলেও, স্বয়ংক্রিয় ডেলিভারি এখনও পুরোপুরি সাধারণ হয়ে ওঠেনি। প্রচলিত ডেলিভারি বাইক এখনো দ্রুততর, সরকারী অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে এবং প্রযুক্তিগত দিকেও কিছু উন্নতির অপেক্ষা রয়েছে। তবু বাজারের নেতৃত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো আত্মবিশ্বাসী—এই প্রযুক্তি আগামী দশকে বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে।
#
চীন, প্রযুক্তি, রোবোভ্যান, স্বয়ংক্রিয় ডেলিভারি, নিলিক্স, পরিবহন, উদ্ভাবন, সারাক্ষণ রিপোর্ট