ঢাকার মোহাম্মদপুর, একসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শান্ত বসতি হিসেবে পরিচিত এই এলাকা এখন ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে ভয় ও অনিশ্চয়তার কেন্দ্রে। গত এক বছরে এই অঞ্চলে ককটেল বিস্ফোরণ, গুলিবিনিময়, রাজনৈতিক সহিংসতা ও গ্যাং চালিত ত্রাসের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। পুলিশের ভাষায়, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও স্থানীয়দের কাছে এটি এখন “অবিরাম আতঙ্কের প্রতিদিন”।
বিস্ফোরণ ও গুলিবিনিময়: সহিংসতার নতুন রূপ
দুই হাজার পঁচিশ সালের তেইশে অক্টোবর ভোরে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে ঘটে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ। স্থানীয় দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় হঠাৎ একটি ককটেল বোমা বিস্ফোরণে বিশ বছর বয়সী এক যুবক নিহত হন। এলাকাবাসীর ভাষায়, “রাতে আতঙ্কে ঘুমাতে পারি না, জানি না কোন দিক থেকে শব্দ আসবে।”
এর আগে ফেব্রুয়ারিতে বশিলা – চল্লিশ ফুট এলাকায় পুলিশের যৌথ অভিযানে গুলিবিনিময়ে দুই ব্যক্তি নিহত হন ও পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, এটি ছিল “অস্ত্রধারী অপরাধচক্র”-এর সঙ্গে সংঘর্ষ, যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদক ও চাঁদাবাজিতে জড়িত ছিল।
গ্যাং ও কিশোর অপরাধ: বাড়ছে নিয়ন্ত্রণহীনতা
গত সেপ্টেম্বর মাসে আদাবর সংলগ্ন বালুরমাঠ এলাকায় একদল কিশোর গ্যাং স্থানীয় বাসিন্দাদের ভয় দেখিয়ে অর্থদাবি করতে থাকে। ‘রোড দশ গ্যাং’ নামের এই দলটি এলাকার দোকান ও টিনশেড ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করত বলে জানা যায়।
একই মাসে নবীনগর খাল সংলগ্ন এলাকায় ‘স্ন্যাচিং’-এর সময় উত্তেজিত জনতা দুইজনকে পিটিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় চারজনকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়।
এসব ঘটনাকে অনেকে “ক্ষুদ্র অপরাধ” বললেও, নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে এটি বড় ধরনের গ্যাং-ভিত্তিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের প্রাথমিক ধাপ—যা অচিরেই ভয়াবহ আকার নিতে পারে।
রাজনৈতিক সহিংসতার ছোঁয়া
এক জুলাই তাজমহল রোডে স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের নেতা দাকুড়াল হাতে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন। ঘটনার পর দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও এলাকাবাসীর দাবি, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে প্রকৃত হোতারা এখনো মুক্তভাবে চলাফেরা করছে।
এই ঘটনাকে অনেকেই দেখছেন মোহাম্মদপুরে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পুনরুত্থান হিসেবে।
কারণ বিশ্লেষণ
এক. অপরিকল্পিত নগরায়ন: মোহাম্মদপুরের ঘনবসতি, অগণিত গলি ও খালপাড়ের অন্ধকার এলাকা অপরাধীদের আড়াল দিচ্ছে।
দুই. নজরদারির সীমাবদ্ধতা: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, “পুরো মোহাম্মদপুরে আমাদের জনবল সীমিত, প্রতিটি গলি কভার করা অসম্ভব।”
তিন. অর্থনৈতিক চাপ ও বেকারত্ব: মাদক ও অবৈধ চাঁদাবাজি এখন অনেক তরুণের বিকল্প আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে।
চার. তথ্যপ্রবাহের দুর্বলতা: এলাকাবাসী ও পুলিশের মধ্যে যোগাযোগ ঘাটতি বাড়ায় অপরাধীরা সুবিধা নিচ্ছে।
জনজীবনে প্রভাব
- • রাতের পর রাস্তায় চলাচল কমে গেছে, দোকান বন্ধ হয় আগেভাগেই।
- • বাড়ি ও দোকানগুলোতে সিসিটিভি ও অতিরিক্ত গার্ড রাখার প্রবণতা বেড়েছে।
- • নারী ও শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে রাতে বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন।
- • এলাকার সামাজিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে; সবাই এখন সবার প্রতি সন্দিহান।
করণীয় ও সম্ভাব্য সমাধান
এক. কমিউনিটি পুলিশিং বাড়ানো: স্থানীয় থানার সঙ্গে নিয়মিত সভা, নাগরিক কমিটি গঠন এবং বাসিন্দাদের তথ্য ভাগাভাগি অপরাধ দমনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
দুই. পর্যাপ্ত আলো ও সিসিটিভি: গলিপথ, খালপাড় ও অন্ধকার এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত আলো স্থাপন এবং ক্যামেরা নজরদারি অপরিহার্য।
তিন. যুব কর্মসংস্থান: বেকার তরুণদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের সুযোগ দিলে গ্যাং-সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখা সম্ভব।
চার. দ্রুত প্রতিক্রিয়া ইউনিট: রাতের বেলা জরুরি মোবাইল ইউনিট বা বিশেষ টহল দল চালু করা যেতে পারে।
মোহাম্মদপুরে যা ঘটছে, তা কেবল কয়েকটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়—এটি শহুরে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভেতরে জমে থাকা এক গভীর সংকেত। বিস্ফোরণ, গ্যাং, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক সহিংসতা—সবকিছুর মিশ্রণে এই এলাকা এখন ঢাকার এক নতুন “রিস্ক জোন”-এ পরিণত হচ্ছে।
যদি এখনই পরিকল্পিত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে মোহাম্মদপুরের এই সীমিত সন্ত্রাস আগামী বছরগুলোতে রাজধানীর বড় নিরাপত্তা সংকটে রূপ নিতে পারে।
# ঢাকা, মোহাম্মদপুর, সন্ত্রাসবাদ, অপরাধ, নিরাপত্তা, গ্যাং সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা, সারাক্ষণ রিপোর্ট