বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক মার্সেল প্রুস্তের ৯০০টি বিরল পাণ্ডুলিপি ফ্রান্সের জাতীয় গ্রন্থাগার কিনতে যাচ্ছে ৭.৭ মিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে। এই অমূল্য সাহিত্যসম্পদে রয়েছে তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস In Search of Lost Time-এর প্রাথমিক খসড়া, ব্যক্তিগত নোট ও অপূর্ণ নাটক পর্যন্ত।
প্রুস্তের ‘পাঁ রাসি’ থেকে ‘মাদেলেইন’
ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত দৃশ্যগুলোর একটি—‘চা-ডোবানো মাদেলেইন’—আসলে প্রায় হতে যাচ্ছিল এক টুকরো বাসি রুটি।
১৯০৭ সালের এক পৃষ্ঠার প্রাথমিক খসড়ায় প্রুস্ত লিখেছিলেন—
“আমি কীভাবে জানব যে সেই গ্রীষ্মের দিনগুলো, সেই বাগান, সেই আকাশ, আমার পরিবারের জীবন—সবই লুকিয়ে আছে ফুটন্ত চায়ের কাপের মধ্যে, যেখানে এক টুকরো বাসি রুটি ভিজছে।”
পরে এই অংশই রূপ নেয় সাহিত্য ইতিহাসের সবচেয়ে রোমান্টিক প্রতীক ‘মাদেলেইন’-এ।

৯০০ পাণ্ডুলিপি কেনার উদ্যোগ
এই ৯০০টি পাণ্ডুলিপি প্রুস্তের উত্তরাধিকারীরা সাদেবিস (Sotheby’s)-এর মাধ্যমে বিক্রির জন্য দিয়েছেন। ফ্রান্সের জাতীয় গ্রন্থাগার (Bibliothèque nationale de France) এগুলো কিনতে চায় ৭.৭ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ৯ মিলিয়ন ডলার) ব্যয়ে।
গ্রন্থাগারের সভাপতি জিল পেকু (Gilles Pécout) বলেন, “প্রুস্ত এমন এক সাহিত্যিক, যার আবেদন সর্বজনীন। এমন আবিষ্কারের স্বপ্ন আমরা দেখিনি।”
ফরাসি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বিনিয়োগ
ফ্রান্সের জাতীয় গ্রন্থাগার আগে ক্যাসানোভার স্মৃতিকথা কিনেছিল ৭ মিলিয়ন ইউরোতে (২০১০ সালে) এবং মার্কুই দ্য সাদের The 120 Days of Sodom সংগ্রহ করেছিল ৪.৫৫ মিলিয়ন ইউরোতে (২০২১ সালে)। প্রুস্তের এই নতুন পাণ্ডুলিপি যুক্ত হলে গ্রন্থাগারটি দাবি করতে পারবে, তারা এখন বিশ্বের প্রায় ৯৫ শতাংশ প্রুস্ত পাণ্ডুলিপির মালিক।
ধনীদের ডিনার আর তহবিল সংগ্রহ
প্যারিসে আয়োজিত এক তহবিল সংগ্রহ অনুষ্ঠানে (প্রতি অতিথির জন্য ১,৫০০ ইউরো টিকিট) প্রদর্শন করা হয় প্রুস্তের কিছু পাণ্ডুলিপি। অতিথিরা বলছিলেন—
“এ যেন তাঁর জীবনের এক টুকরো অংশ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে,” বলেন ব্রাজিলীয় ইতিহাসবিদ পেদ্রো কোরেয়া দো লাগো।
চিত্রশিল্পী ফাবিয়েন ভার্দিয়ে বলেন, “আমি দেখেছি, আর কেঁদেছি।”

প্রুস্তের লেখার বিবর্তন
সাদেবিসের প্রদর্শিত পাণ্ডুলিপিগুলো প্রমাণ করে, প্রুস্ত তাঁর বিখ্যাত অনুচ্ছেদে কতবার পরিবর্তন এনেছিলেন—
‘পাঁ রাসি’ (বাসি রুটি) থেকে ‘পাঁ গ্রিলে’ (টোস্ট), তারপর ‘বিসকট’—এভাবে দীর্ঘ সংশোধনের পর আসে চূড়ান্ত শব্দ ‘মাদেলেইন’।
প্রুস্ত প্রতিটি শব্দ নিয়ে এতটাই নিখুঁত ছিলেন যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৯২২) শেষ তিন খণ্ডের সংশোধন চালিয়ে গেছেন।
আবিষ্কারের গল্প
এই ৯০০ পাণ্ডুলিপি হঠাৎ আলোচনায় আসে ২০১৮ সালে, ফরাসি প্রকাশক বার্নার দ্য ফালোয়ার মৃত্যুর পর। প্রুস্ত পরিবার একসময় গবেষণার জন্য তাঁকে কিছু পাণ্ডুলিপি দিয়েছিল, যা তিনি কখনো ফেরত দেননি। তাঁর মৃত্যুর পর সেগুলোই উদ্ধার করে ফেরত দেয় পরিবারকে। পরে ২০১৯ সালে উত্তরাধিকারীরা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।
‘অ্যাবসোলিউট ট্রেজার’
সাদেবিসের বিশেষজ্ঞ বেনোয়া পুত্তেমা দুই বছর ধরে পাণ্ডুলিপিগুলো শ্রেণিবিন্যাস ও সংরক্ষণ করেন। তিনি গুরুত্ব অনুযায়ী এগুলোকে ‘S’ (small) থেকে ‘XL’ (extra-large)—মানে ‘অমূল্য সম্পদ’—এইভাবে ভাগ করেছেন।
সরকার ও দাতাদের ভূমিকা
ফরাসি সরকার এই পাণ্ডুলিপিগুলোকে “জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য” হিসেবে ঘোষণা করেছে, ফলে দাতারা করছাড় পাবেন। এ ঘোষণায় ধনী ফরাসি ও আন্তর্জাতিক দাতাদের উৎসাহিত করার আশা করছে কর্তৃপক্ষ।
তবে সুইস-ভিত্তিক মার্টিন বডমার ফাউন্ডেশনের পরিচালক জ্যাক বার্শটোল্ড সতর্ক করে বলেন, “জাতীয় গ্রন্থাগারের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই, সবাইকেই সাহায্য করতে হবে।”

তহবিল সংগ্রহের ডিনারে অতিথিদের পরিবেশন করা হয় চকোলেট মেরিঙ্গ কেক ও ব্ল্যাকবেরি সারবেতের সঙ্গে ছোট ছোট মাদেলেইন—যেগুলো, দুর্ভাগ্যবশত, কিছুটা শুকনো ও নিস্বাদ ছিল।
প্রুস্তের মতোই হয়তো ওগুলোও একটু চায়ের কাপে ডুবিয়ে খাওয়া দরকার ছিল—ঠিক যেমন তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন সময়ের স্বাদ চেনাতে।
#মার্সেল_প্রুস্ত /# ফ্রান্স /# সাহিত্য /# পাণ্ডুলিপি / #সাদেবিস /# ফরাসি_গ্রন্থাগার /#W ইন_সার্চ_অব_লস্ট_টাইম /# সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















