দীর্ঘদিন ধরে থিয়েটারে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন নারী দর্শক, কিন্তু সম্প্রতি চীনা চলচ্চিত্রশিল্প সেই বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে নতুন ধারা তৈরি করছে। নারী নির্মাতা, অভিনেত্রী ও প্রযোজকরা এখন পর্দায় তুলে ধরছেন নারীর অনুভূতি, স্বাধীনতা ও বাস্তব জীবনের গল্প—যা বদলে দিচ্ছে দেশের সিনেমার কাঠামো ও বাজারের দিকনির্দেশনা।
নারীকেন্দ্রিক গল্পের উত্থান
চীনে এ সপ্তাহের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্রটি কোনো আন্তর্জাতিক তারকার ছবি নয়, বরং নারী বন্ধুত্বের গল্পে নির্মিত লি ইউ পরিচালিত “আফটার টাইফুন”। দেশের সবচেয়ে বড় টিকিটিং প্ল্যাটফর্ম মাওইয়ানের তথ্য অনুযায়ী, এটি দর্শকদের ‘মাস্ট ওয়াচ’ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
অভিনেত্রী ও প্রযোজক ইয়াও চেন বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে থিয়েটারে নারী দর্শকই সংখ্যায় বেশি—তারাই টিকিট কেনেন, সিনেমা বেছে নেন। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি বিষয়টি সম্প্রতি বুঝতে শুরু করেছে।”
সিনেমা হলে নারীদের প্রভাব
চীনের চলচ্চিত্র খাত, যা রাজস্বের দিক থেকে এশিয়ার সবচেয়ে বড়, মহামারির পর থেকে বক্স অফিসে মন্দা কাটাতে পারেনি। পরিবর্তিত বিনোদন-অভ্যাস, অনলাইন প্রতিযোগিতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দর্শকসংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে।
তবে এই পরিস্থিতি নারী নির্মাতাদের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে—যেখানে তারা পুরুষতান্ত্রিক যুদ্ধ বা সংঘর্ষকেন্দ্রিক ধারার বাইরে নারীদের অনুভূতি ও জীবনের গল্প বলছেন।
নারী নির্মাতাদের সাফল্যের ধারা
গত বছর নারী পরিচালিত ছবির মধ্যে সবচেয়ে বড় হিট ছিল জিয়া লিং-এর “YOLO”—এক গৃহবন্দী নারীর জীবনে আত্মনিবেদনের গল্প। ছবিটি দেশীয় বক্স অফিসে ৩.৪২ বিলিয়ন ইউয়ান আয় করে। এরপর আসে “হার স্টোরি”, যেখানে এক একক মা, তার মেয়ে ও এক প্রতিবেশী নারীর সংগ্রামের গল্প তুলে ধরা হয়; আয় করে ৭১২.৯ মিলিয়ন ইউয়ান।
চীনের ‘ফার্স্ট ফ্যান্টাস্টিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, “এটি এমন এক সময়, যখন নারী সৃজনশক্তি চলচ্চিত্রশিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভূমিকা রাখছে—নারীর পর্দাচিত্র বদলে দিচ্ছে এবং সৃজনশীল বৈচিত্র্য ও লিঙ্গসমতার দিকে শিল্পকে এগিয়ে নিচ্ছে।”
সমাজ ও রাষ্ট্রের দ্বৈত বাস্তবতা
একদিকে নারীকণ্ঠ শক্তিশালী হচ্ছে চলচ্চিত্রে, অন্যদিকে বেইজিংয়ে নারীবাদ নিয়ে সরকারের কড়া অবস্থান দেখা যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নারীদের পরিবার ও সন্তান পালনে মনোযোগী হতে উৎসাহিত করছেন, আর অনেক সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার ও কৌতুকশিল্পীকে পুরুষবিরোধী মন্তব্যের অভিযোগে সেন্সর করা হয়েছে।
তবুও বাজারই এখন গল্প বলছে—নারীকেন্দ্রিক কাহিনিই বিক্রি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। উহানের প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ জিনিউ ডিংয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে সিনেমার প্রায় ৬০ শতাংশ টিকিট ক্রেতা নারী, এবং ‘পোস্ট-৯৫’ প্রজন্মের তরুণীরাই প্রধান ভোক্তা শ্রেণি।
শতবর্ষ পেরিয়ে নতুন প্রভাব
চীনে নারী পরিচালকদের যাত্রা শুরু হয় ১৯২৫ সালে শিয়ে কাইঝেনের “অ্যান অরফানস ক্রাই” দিয়ে। কিন্তু বাণিজ্যিক সাফল্যের দিক থেকে তাদের উপস্থিতি নতুন যুগে দৃশ্যমান হয়েছে।
বেইজিংয়ের চলচ্চিত্র সমালোচক হে শিয়াওছিন বলেন, “শাও ইহুই ও তেং চংচংয়ের কাজগুলোতে নারীবোধ স্পষ্ট, এবং সেগুলো সফলও হয়েছে। এর ফলে অন্যান্য নির্মাতারাও নারী দর্শকদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করছেন—এটি সামাজিক অগ্রগতির প্রতিফলন।”
শিল্পে সমান সুযোগের পথে
পরিচালক ইয়াং লিনা, যার “বিগ ওয়ার্ল্ড” ৭৬৫.৯ মিলিয়ন ইউয়ান আয় করে, বলেন, “১৯৯০-এর দশকের শেষ থেকে অনেক নারী চলচ্চিত্রে যুক্ত হচ্ছেন। আজকের সমাজে নারীদের বিকল্প বাড়ছে—তারা ঘরে বা কর্মক্ষেত্রে, উভয় জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেন। এখন চলচ্চিত্রেও সমান প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।”
এম্পেরর মোশন পিকচার্সের প্রকল্প পরিচালক লিন লিয়াং বলেন, “নারীরা এখন নিজেদের গল্প পর্দায় দেখতে চান। তাদের আবেগ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি চাহিদা তৈরি করছে, আর পুঁজিও এখন নারীকেন্দ্রিক সৃজনশীলতার সম্ভাবনা বুঝতে পারছে।”
নারীদের আত্মপ্রকাশ ও অনুপ্রেরণা
ডৌবান ও শিয়াওহংশু’র মতো নারীবান্ধব সামাজিক প্ল্যাটফর্মে নারীবাদী বিষয় নিয়ে আলোচনা বাড়ছে। অনেক ব্যবহারকারী লিখছেন, “এখন মনে হয় আমরা দৃশ্যমান হচ্ছি, বোঝা হচ্ছি।”
শাংহাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অভিনেত্রী লিয়াং জিং বলেন, “নারীদের ভয় না পেয়ে কথা বলতে হবে, প্রাচীর ভাঙতে হবে, নিজের কণ্ঠ খুঁজে পেতে হবে।”
রাজনীতি নয়, বাস্তব জীবনের গল্প
নারী পরিচালকরা রাজনৈতিক বিষয় এড়িয়ে বাস্তব জীবন ও আবেগের গল্পে বেশি মন দিচ্ছেন। জিয়া লিং-এর “হাই, মম” (২০২১) ৫.৪২ বিলিয়ন ইউয়ান আয় করে একক নারী পরিচালকের সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছিল, যা পরে “বার্বি” ছাড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে “সেন্ড মি টু দ্য ক্লাউডস”-এ ইয়াও চেন এক নারীর যৌনতা ও আত্মপরিচয় অন্বেষণ দেখিয়েছেন ক্যান্সার নির্ণয়ের পর। তিনি বলেন, “দর্শকরা আর নিখুঁত পুরুষ চরিত্রে আগ্রহী নয়—তারা বাস্তব ও জটিল চরিত্র দেখতে চান।”
আন্তর্জাতিক প্রযোজনায় নারীদের অগ্রগতি
হংকংয়ের মিরাজ ফিল্মসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এসথার লি বলেন, “চীনা চলচ্চিত্রে এখন নারীবাদ, স্বাধীনতা ও সংগ্রামের বিষয়গুলো নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। নির্মাতারা আন্তর্জাতিক সহ-প্রযোজনার দিকেও এগোচ্ছেন।”
তার সহ-প্রযোজিত “হুইস্পারিংস অব দ্য মুন” ছবিটি বুসানে বিশ্বপ্রিমিয়ার করে—চীনা পরিচালক লাই ইউকিংয়ের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, যা ফনম পেনে দুই নারীর সম্পর্ক নিয়ে নির্মিত।
লাই বলেন, “চলচ্চিত্র নির্মাণ সবসময় কঠিন, কিন্তু আমরা নারী দল হিসেবে এক অভিন্ন আকাঙ্ক্ষায় কাজ করেছি—নারীদের গল্প বলার তাগিদেই।”
নতুন প্রজন্মের পথচলা
তিয়ানজিনে জন্ম নেওয়া লাই ইউকিং নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস ও টরন্টো’তে পড়াশোনা শেষে এশিয়ায় ফিরে এসেছেন পরিচালনায় হাত পাকাতে। তিনি বলেন, “দ্বিতীয় চলচ্চিত্রের পথ আরও কঠিন হবে, তবুও আমি থামব না—কারণ এখন আর থামা সম্ভব নয়।”
# চীনা_সিনেমা, নারী_পরিচালক, চলচ্চিত্র_বাজার, নারীবাদ, এশিয়া_সংস্কৃতি, বিনোদন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















