প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এশিয়া সফরে যাচ্ছেন এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্যযুদ্ধ, ইসরায়েল–গাজা সংঘাত ও ইউক্রেন সংকট আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। পাঁচ দিনের এই সফরে তিনি বাণিজ্য চুক্তি, যুদ্ধবিরতি ও কূটনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন।
এশিয়া সফরের মূল লক্ষ্য: চুক্তি ও কূটনৈতিক ভারসাম্য
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এশিয়া সফরে যাচ্ছেন এমন এক সময়, যখন তারই আরোপিত শুল্ক নীতিতে অঞ্চলটি ক্ষতিগ্রস্ত। শুক্রবার রাতে ওয়াশিংটন ত্যাগ করে তিনি পাঁচ দিনের সফরে মালয়েশিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যাচ্ছেন—এটি তার দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর পর সবচেয়ে দীর্ঘ বিদেশ সফর।
এই সফরের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বহু প্রতীক্ষিত বৈঠক, যা বৃহস্পতিবার দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে হওয়ার সম্ভাবনা। সফরের মাধ্যমে ট্রাম্প বাণিজ্য, গুরুত্বপূর্ণ খনিজসম্পদ এবং যুদ্ধবিরতি বিষয়ক চুক্তিগুলো চূড়ান্ত করার চেষ্টা করবেন।
ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধবিরতি রক্ষা ও আন্তর্জাতিক চাপ
ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের সবচেয়ে বড় পররাষ্ট্রনীতি অর্জন—ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধবিরতির—স্থিতি বজায় রাখতেও সচেষ্ট রয়েছেন। এর পাশাপাশি ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন ও চীনের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্য উত্তেজনা ও সম্ভাব্য চুক্তির রূপরেখা
ওয়াশিংটন ও বেইজিং একে অপরের রপ্তানিতে শুল্ক বৃদ্ধি করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও প্রযুক্তি বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ আরোপের হুমকি দিয়েছে।
হোয়াইট হাউস বৃহস্পতিবার সফরটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেও, শি–ট্রাম্প বৈঠকের বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত। সূত্রমতে, কোনো বড় অগ্রগতি বা পুরোনো বাণিজ্য চুক্তি পুনর্বহালের আশা দুই পক্ষই করছে না।
বৈঠকের প্রস্তুতিতে দুই দেশ মূলত মতভেদ নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত অগ্রগতির ওপর জোর দিচ্ছে। সম্ভাব্য অন্তর্বর্তী চুক্তিতে সীমিত শুল্ক ছাড়, বিদ্যমান হারের মেয়াদ বৃদ্ধি, কিংবা চীনের পক্ষ থেকে মার্কিন তৈরি সয়াবিন ও বোয়িং বিমান কেনার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে—যা ২০২০ সালের এক চুক্তিতে প্রতিশ্রুত হলেও পরে বেইজিং তা ভঙ্গ করেছিল।
এর বিপরীতে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের দিকে কিছু উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন চিপ রপ্তানির অনুমতি দিতে পারে, আর বেইজিং বিরল খনিজ রপ্তানিতে শিথিলতা আনতে পারে। তবে আলোচনায় কোনো ফলাফলও নাও আসতে পারে।
‘আনুষ্ঠানিক নয়’ বৈঠক, তবু প্রত্যাশা উঁচু
মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসান্ট জানিয়েছেন, ট্রাম্প–শি আলোচনা সম্ভবত একটি অনানুষ্ঠানিক “পুল-অ্যাসাইড” বৈঠক হবে। তবে ট্রাম্প বলেছেন, এটি “লম্বা বৈঠক” হতে পারে যেখানে “অনেক প্রশ্ন ও দ্বিধা নিরসন” সম্ভব।
চীন এখনো বৈঠকটির বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেনি।
তিন দেশ সফর ও গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকসমূহ
ট্রাম্প প্রথমে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দেবেন। কুয়ালালামপুরে তিনি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে জুলাইয়ে সংঘর্ষ-পরবর্তী যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর তদারক করতে পারেন।
মালয়েশিয়া যাত্রাপথে কাতারে জ্বালানি নেওয়ার সময় তিনি দেশটির আমির ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ করবেন—যারা গাজা যুদ্ধের মধ্যস্থতায় ভূমিকা রাখছেন।
এরপর ট্রাম্প যাবেন জাপানে, যেখানে নতুন প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির সঙ্গে বৈঠকে প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনা পুনর্ব্যক্ত হতে পারে।
সবশেষে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দেবেন।
বাণিজ্যচুক্তি ব্যর্থ হলে নতুন শুল্ক হুমকি
ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ১ নভেম্বর থেকে চীনা পণ্যে মোট ১৫৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হতে পারে যদি কোনো চুক্তি না হয়। এতে দ্বিপাক্ষিক “বাণিজ্যবিরতি” শেষ হয়ে নতুন সংঘাত শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বৈঠকে তাইওয়ান ইস্যু, রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা ও রুশ তেল কেনাসহ বেশ কয়েকটি সংবেদনশীল বিষয় আলোচনায় উঠতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ট্রাম্প মূলত বাণিজ্য ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ নিয়েই কথা বলবেন।
হংকংয়ের জিমি লাই ও উত্তর কোরিয়া প্রসঙ্গ
ওয়াশিংটন ছাড়ার আগে ট্রাম্প জানান, তিনি শির সঙ্গে আলোচনায় হংকংয়ের কারারুদ্ধ সংবাদপত্র মালিক জিমি লাইয়ের মুক্তির বিষয়টিও তুলবেন। তিনি বলেন, “বিষয়টি আমার তালিকায় আছে, দেখা যাক কী হয়।”
এছাড়া ট্রাম্পের কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির সঙ্গে পুনরায় বাণিজ্য আলোচনা বসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে বুধবার এক নৈশভোজে দুই নেতা দেখা করতে পারেন।
দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে নতুন বাণিজ্যচেষ্টা
ট্রাম্প মালয়েশিয়া ও ভারতের সঙ্গে নতুন বাণিজ্যচুক্তি করার পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে পূর্ববর্তী চুক্তি স্থিতিশীল করতে চান। তবে সিউল ৩৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দাবি ও বিদেশি শ্রমিক প্রত্যাবাসন ইস্যু নিয়ে ক্ষুব্ধ।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং চান, ট্রাম্প যেন উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসেন। যদিও ট্রাম্প–কিম বৈঠক এখনো নির্ধারিত হয়নি।
অনিশ্চয়তার মাঝেই ট্রাম্পের কূটনৈতিক পরীক্ষা
এশিয়া সফর ট্রাম্পের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক পরীক্ষা—যেখানে বাণিজ্যচুক্তি, আঞ্চলিক সংঘাত, এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন—সবই এক সুতোয় বাঁধা। সফল হলে এটি হবে তার দ্বিতীয় মেয়াদের বড় অর্জন; ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র–চীন উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেতে পারে।
#ট্রাম্প #চীন #এশিয়া_সফর #বাণিজ্যচুক্তি #শি_জিনপিং #যুক্তরাষ্ট্র_চীন_সম্পর্ক #ইসরায়েল_গাজা_যুদ্ধবিরতি #দক্ষিণ_কোরিয়া #জাপান #মালয়েশিয়া
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















