উত্তেজনার মধ্যেও সঙ্গীতের আহ্বান
নিউইয়র্কের কার্নেগি হলে ইসরায়েল ফিলহারমোনিক অর্কেস্ট্রার টিকিট কিনলে আপনি শুধু সঙ্গীত শুনতে যাচ্ছেন না — সঙ্গে থাকছে প্রতিবাদ, নিরাপত্তা তল্লাশি ও বিলম্বিত সূচনা। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতির ঠিক পরেই গত সপ্তাহে চারদিনের জন্য দলটি যখন কার্নেগিতে ফিরে আসে, তখন পরিবেশ ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ।
অর্কেস্ট্রার সঙ্গীত পরিচালক লাহাভ শানি (যিনি ২০২০ সাল থেকে দায়িত্বে) দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-কে বলেন, “ইসরায়েল ফিলহারমোনিক কোনো দল বা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে না — আমরা কথা বলি সঙ্গীতের ভাষায়।”
তবে বাস্তবতা আরও জটিল। সরকার থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ ভর্তুকি পাওয়া এই প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারি জীবনীতে বর্ণনা করা হয় “ইসরায়েলের প্রধান সাংস্কৃতিক দূত” হিসেবে। অতীতে তাদের অনেক পরিবেশনা শুরু হয়েছে জাতীয় সংগীত ‘হাতিকভা’ দিয়ে — যা এবার ইচ্ছাকৃতভাবে বাজানো হয়নি।
সঙ্গীতের গুণ ও সীমাবদ্ধতা
শানির নেতৃত্বে অর্কেস্ট্রা নতুন যুগে প্রবেশ করেছে, তবে সমালোচকরা বলছেন — তার উপস্থাপনা কখনও উজ্জ্বল, আবার কখনও বিক্ষিপ্ত। তিনি ইউরোপে বেশ পরিচিত এবং আগামী বছর মিউনিখ ফিলহারমোনিকের প্রধান কন্ডাক্টর হিসেবেও দায়িত্ব নেবেন।

কার্নেগিতে অনুষ্ঠিত এক চেম্বার কনসার্টে শানি নিজে পিয়ানো বাজান। ক্ল্যারিনেটবাদক রন সেলকার সঙ্গে তিনি পল বেন-হাইমের “সংস উইদাউট ওয়ার্ডস” পরিবেশন করেন সুরেলা ও আবেগঘনভাবে। পরে চারজন তারবাদকের সঙ্গে দিমিত্রি শোস্তাকোভিচের পিয়ানো কুইন্টেট পরিবেশনায় তিনি দেখান অসাধারণ সংহতি ও আবেগ।
তবে বড় দল নিয়ে তার পরিবেশনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। লিওনার্ড বার্নস্টাইনের ‘হালিল’ পরিবেশনায় ছিল শূন্যতার সৌন্দর্য, কিন্তু চাইকোভস্কির শেষ তিনটি সিম্ফনি পরিবেশনায় সেই সূক্ষ্মতা অনুপস্থিত ছিল। শানির অঙ্গভঙ্গি ছিল নাটকীয়, কিন্তু তার ফলে সঙ্গীতের সূক্ষ্মতা হারিয়ে যায়; যেন শব্দের জোরই প্রকাশের একমাত্র ভাষা।
ছন্দপতন ও সুরের সংঘাত
ছয় নম্বর সিম্ফনির রোমান্টিক অংশগুলো ছিল অস্পষ্ট, তৃতীয় মুভমেন্টের হালকাতা পরিণত হয় অনির্দিষ্ট গুঞ্জনে। কিছু স্থানে তিনি সময়ের সঙ্গে টানাপোড়েনে পড়ে যান — মনে হয় যেন সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে এক ধরনের “টাগ অব ওয়ার” চলছে।
তবে ইসরায়েলি সুরকার পল বেন-হাইমের রচনাগুলোর ক্ষেত্রে শানি ও তার দল ছিলেন অসাধারণ। এই জার্মান-জন্ম সুরকার ১৯৩৩ সালে তেল আবিবে চলে আসেন এবং ইসরায়েলের সঙ্গীত জগতে পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। তার সিম্ফনি নং ১, যা ১৯৪১ সালে প্যালেস্টাইন সিম্ফনি (বর্তমান ইসরায়েল ফিলহারমোনিক) পরিবেশন করেছিল, ইসরায়েলের প্রথম সিম্ফনি হিসেবে বিবেচিত।

বেন-হাইমের উত্তরাধিকার
বেন-হাইমের সুরে জার্মান শাস্ত্রীয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া থাকলেও তাতে মিশে থাকে স্থানীয় লোকসঙ্গীতের ছন্দ। তার ভায়োলিন কনসার্টো — যা কার্নেগিতে পরিবেশন করেন পিনচাস জুকারমান — ছিল পরিশীলিত কিন্তু ইউরোপীয় রোমান্টিক ঘরানার ছায়ায়।
সবচেয়ে অনন্য ছিল সিম্ফনি নং ২, যেখানে অর্কেস্ট্রা চমৎকারভাবে তুলে ধরে গ্রামের শান্তি থেকে শুরু করে নৃত্যময় উচ্ছ্বাস, গভীর হতাশা এবং শেষে লোকজ আনন্দ ও মহিমায় ভরা চূড়ান্ত পর্ব। সেই মুহূর্তে, সঙ্গীত যেন সাময়িকভাবে মুছে দেয় বাইরের রাজনৈতিক উত্তেজনার ভার — শ্রোতারা আবার মনে করেন, সঙ্গীতই শেষ পর্যন্ত মানবতার ভাষা।
ইসরায়েল ফিলহারমোনিক আজ এক সংকটময় সময়ে দাঁড়িয়ে — রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘেরা এক সঙ্গীতদল, যারা চেষ্টা করছে শুধুমাত্র সঙ্গীতের মাধ্যমে কথা বলতে। কিন্তু কার্নেগি হলের পরিবেশ, নিরাপত্তা, প্রতিবাদ আর সংঘর্ষের মধ্যে সেই সঙ্গীতও যেন মাঝে মাঝে রাজনীতির প্রতিধ্বনিতে ঢেকে যায়। তবু লাহাভ শানির নেতৃত্বে দলটি মনে করিয়ে দিচ্ছে — শান্তির জন্য সুরই হয়তো সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















