ইঙ্গান্ডার বন থেকে নতুন আশার গল্প
কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (ডিআরসি) গভীর অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত ইঙ্গান্ডা গ্রামটি আজ আফ্রিকার সংরক্ষণ প্রচেষ্টার এক অনন্য উদাহরণ। নয় ঘণ্টার পথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় এই অঞ্চলে, যেখানে বান্তু ও পিগমি জনগোষ্ঠী কাঁচা মাটির ঘরে বসবাস করে। গাছের ঘন ছায়ায় সূর্যের আলো মাটি ছুঁতে পারে না, তবে অল্প হাঁটলেই দেখা মেলে আলোকিত ক্যাসাভা ক্ষেতের। আশ্চর্যের বিষয়, বৃহৎ গাছগুলো কাটা হয়নি—ফলে এখানে আবার ফিরে আসছে সাপ ও শিম্পাঞ্জির মতো প্রাণী। স্থানীয় গাইড জানালেন, গ্রামবাসীরা এখন আর বন্যপ্রাণী শিকার করে না, বরং সংরক্ষণে উৎসাহী।
বনরক্ষায় নরওয়ের অর্থায়নে নতুন পদ্ধতি
এই পরিবর্তনের পেছনে আছে নরওয়ের সহায়তায় গঠিত “কমিউনিটি ফান্ড ফর ফরেস্টস (CFF)”। এই তহবিলের মূল ধারণা হলো—গ্রামবাসীরা যদি নিজেদের জমির কিছু অংশ উন্নয়ন থেকে বিরত রাখে, তবে তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এতে ‘স্ল্যাশ-অ্যান্ড-বার্ন’ চাষের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে এবং কাঠ ব্যবসায়ীদের আগ্রাসনও প্রতিরোধ হবে। এমন উদ্যোগ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে চলছে, যেন অ্যামাজনের মতো বন ধ্বংসের ইতিহাস এখানে না ঘটে।

বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি ও আফ্রিকার ভূমিকা
নভেম্বরে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (COP30) সামনে রেখে আফ্রিকার প্রকৃতি এখন বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীর অক্ষত ইকোসিস্টেমের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি রয়েছে আফ্রিকায়, আর কঙ্গো অববাহিকা পৃথিবীর বৃহত্তম কার্বন-শোষক অঞ্চল। জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৩০% ভূমি ও সমুদ্র সংরক্ষণের অঙ্গীকার করেছে, কিন্তু অগ্রগতি সামান্য। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে আফ্রিকার বন ও বন্যপ্রাণ রক্ষা অপরিহার্য।
উপনিবেশিক সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতা
আগের সংরক্ষণ মডেলগুলোর অনেকটাই উপনিবেশিক মানসিকতায় তৈরি। জাতীয় উদ্যানগুলো পর্যটন থেকে সরকারের আয় বাড়ালেও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর লাভ কম। কঙ্গো-ব্রাজাভিলের ‘বাকা’ গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ওপর রেঞ্জারদের নির্যাতনের খবর এসেছে। এমনকি ভালোভাবে পরিচালিত উদ্যানগুলোও ‘অর্ধ-সংরক্ষিত’ এলাকাগুলোকে বাঁচাতে পারে না, যেখানে বন্যপ্রাণী, গবাদিপশু ও মানুষ একসাথে বসবাস করে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর হাতে প্রকৃতি রক্ষার সম্ভাবনা
CFF একটি বিকল্প দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যথাযথ প্রণোদনা পেলে স্থানীয় ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর বনরক্ষক। ইঙ্গান্ডায় যেমন নগদ অর্থ, উন্নয়ন সুবিধা ও জমির আইনি মালিকানা সুরক্ষার মাধ্যমে মানুষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমিত কৃষিকাজে, বাকি অরণ্য অক্ষত রাখার জন্য।

বাস্তব চ্যালেঞ্জ ও প্রণোদনার দ্বন্দ্ব
বর্তমানে গ্রামবাসীরা CFF-এর টাকা পেয়ে সন্তুষ্ট হলেও ভবিষ্যতে বন বিক্রি বা ব্যবহার করে বেশি লাভ হলে তারা এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারে। পাশের এক গ্রামে চীনা কাঠ কোম্পানিকে জমি বিক্রি করে বড় রাস্তা নির্মাণের উদাহরণ ইতিমধ্যেই রয়েছে। দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামো, জমির অধিকার রক্ষা করতে পারছে না।
কেনিয়ার অভিজ্ঞতা ও নতুন প্রযুক্তি
নাইরোবির কাছে কিটেঙ্গেলা-কিপেটো অঞ্চলেও একই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। স্থানীয়রা বলেন, দাতা সংস্থার দেওয়া জমি সংরক্ষণের বিনিময়ে পাওয়া অর্থ জমির প্রকৃত মূল্যের সমান নয়। তাই কেউ কেউ জমি বিক্রি করছে, ফলে বন্যভূমি এখন ভেঙে যাচ্ছে খনি ও কৃষিজমিতে।
এই প্রেক্ষাপটে কেনিয়ার স্টার্টআপ ‘আর্থএকর’ তৈরি করেছে একটি ডিজিটাল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা ‘বায়োডাইভারসিটি ক্রেডিট’ বা ‘প্রকৃতি সম্পদ’ বিক্রি করে আয় করতে পারবেন। ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীরা এই ক্রেডিট কিনে পরিবেশ ক্ষতির ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করবে। পাশাপাশি ‘কার্বন ক্রেডিট’ বাজারও এতে যুক্ত হবে, যাকে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো দেশটির পরবর্তী বড় রপ্তানি খাত হিসেবে দেখছেন।
ক্ষুদ্র সাফল্য ও বড় স্বপ্ন
৬৭ বছর বয়সী মাসাই বিধবা ফিলিস এনকাপাপা তার প্রথম বায়োডাইভারসিটি পেমেন্ট ১৮ হাজার কেনিয়ান শিলিং (প্রায় ১৪০ ডলার) পেয়ে নাতিদের পড়াশোনার খরচ মিটিয়েছেন। বিনিময়ে তিনি গাছ লাগাচ্ছেন, ঘাসের ঢাল রক্ষা করছেন এবং জমি খোলা রাখছেন যাতে সিংহসহ বন্যপ্রাণী চলাচল করতে পারে।
‘আর্থএকর’ স্যাটেলাইট ও সেন্সর প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিটি পাতার অবস্থা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে প্রকৃতির মান নির্ধারণ করছে। এই তথ্য বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে ‘সবুজ বিনিয়োগ’-এ অর্থপ্রবাহ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে।
অর্থায়নের অভাব ও বৈশ্বিক সংকট
তবে এই উদ্যোগগুলোকে কার্যকর করতে দরকার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ। বর্তমানে বৈশ্বিক ‘বায়োডাইভারসিটি ক্রেডিট’ বাজারের মূল্য মাত্র ১০ মিলিয়ন ডলারের কম। জাতিসংঘের বন সংরক্ষণ লক্ষ্যে বছরে ৭০০ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি রয়েছে। কার্বন বাজারও নানা বিতর্কে ক্ষতিগ্রস্ত—বিশেষত ‘গ্রিনওয়াশিং’-এর অভিযোগে। ধনী দেশগুলো জলবায়ু তহবিলে কাটছাঁট করায় নতুন বাজার গড়ে ওঠাও কঠিন হচ্ছে।

গ্যাবনের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ আশাবাদ
গ্যাবনের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী লি হোয়াইট একসময় বিশ্বাস করতেন, বড় বনসম্পন্ন দেশগুলো গাছ বাঁচিয়ে বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। টেকসই কাঠ আহরণের মাধ্যমে গ্যাবনে ১৯৯০ সালের পর থেকে বন্যহাতির সংখ্যা ৬০% বেড়েছে। সাম্প্রতিক সামরিক সরকারও সেই পরিবেশ নীতি ধরে রেখেছে।
তবে বর্তমানে তিনি আগের মতো আশাবাদী নন। ধনী দেশগুলোর অঙ্গীকার শিথিল, আর ‘ন্যাচারাল ক্যাপিটাল’ বাজারের গতি ধীর। তবু আফ্রিকার সংরক্ষণকর্মীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—বন ও বন্যপ্রাণ রক্ষা করে উন্নয়ন সম্ভব, তা প্রমাণ করতেই তারা লড়ে যাচ্ছেন।
#সংরক্ষণ #আফ্রিকা #কঙ্গোবন #জলবায়ুপরিবর্তন #বায়োডাইভারসিটি #কার্বনক্রেডিট #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















