কুয়ালালামপুরে শান্তি সম্মেলনের প্রস্তুতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার আসন্ন সফরে এক বিশেষ লক্ষ্য নিয়েই যাচ্ছেন—কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে শান্তিচুক্তি সই করানো। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ২৬ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠিতব্য একাধিক আঞ্চলিক বৈঠকে যোগ দেবেন বিশ্বের ডজনখানেক দেশের নেতা, আর ট্রাম্পও তাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন। তবে কূটনীতিকদের মতে, তিনি তাইওয়ান বা দক্ষিণ চীন সাগর সংক্রান্ত বড় নিরাপত্তা ইস্যুর বদলে এই সীমান্ত বিরোধ মেটাতেই বেশি মনোযোগী।
সীমান্ত সংঘাতের প্রেক্ষাপট
গত জুলাই মাসে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সীমান্ত এলাকায় পাঁচ দিনের সংঘর্ষে অন্তত ৪৩ জন নিহত ও লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। দীর্ঘদিনের ভূখণ্ড বিরোধের জেরে এই সংঘর্ষ শুরু হয়, যা একসময় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করে। পরে ট্রাম্প দুই দেশের ওপর আমেরিকান শুল্ক বাড়ানোর হুমকি দেন, এবং তার এই অপ্রচলিত পদক্ষেপের পরই যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়।
যদিও যুদ্ধবিরতির পরও উত্তেজনা পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। দুই দেশই সীমান্ত থেকে সেনা সরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। থাইল্যান্ড ১৮ জন কম্বোডিয়ান বন্দিকে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, এবং আসিয়ান (ASEAN) পর্যবেক্ষকদের বিতর্কিত এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। অবসরপ্রাপ্ত হলেও কম্বোডিয়ার শক্তিশালী নেতা হুন সেন সামাজিক মাধ্যমে থাইল্যান্ডবিরোধী মন্তব্য চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল ক্ষমতায় এসেই কঠোর অবস্থানের অঙ্গীকার করেছেন।

ট্রাম্পের লক্ষ্য: ‘শান্তিদূত’ হিসেবে ভাবমূর্তি
ট্রাম্প এই জটিল প্রেক্ষাপট কতটা বুঝছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা বলছেন, তিনি এমন এক অনুষ্ঠান চান যা তাঁকে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীকে একত্রিত করার মধ্য দিয়ে ‘মহান শান্তিদূত’ হিসেবে উপস্থাপন করবে। যদিও তিনি চাইলে এই মুহূর্তে উভয় পক্ষকে স্থায়ী শান্তির পথে বাধ্য করতে পারতেন, তবু ধারণা করা হচ্ছে, জুলাইয়ের যুদ্ধবিরতির শর্তগুলোই কেবল নতুন করে আলোচনায় তুলে ধরা হবে—প্রচুর ক্যামেরার ঝলকের সঙ্গে।
কৌশলগত দৃষ্টিকোণে সফরের গুরুত্বহীনতা
মালয়েশিয়া সফরের মূল ফোকাস যদি এই সীমিত শান্তি উদ্যোগ হয়, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কিছুটা হতাশাজনক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সফর সচরাচরই বিরল। আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নেওয়া মিত্র দেশগুলো তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে চীনের আগ্রাসন নিয়ে মুখ খুলতে প্রস্তুত, কিন্তু ট্রাম্পের সূচি অনুযায়ী তিনি ওই বৈঠক শুরু হওয়ার আগেই মালয়েশিয়া ছাড়বেন।
চীনের প্রভাব বৃদ্ধি ও মার্কিন প্রান্তিকতা
জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী তাকাইচি সানায়ে-ও আগে চলে যাবেন, যাতে ট্রাম্পকে জাপানে স্বাগত জানাতে পারেন। ফলে আসিয়ান সম্মেলনের শেষ দিন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং এককভাবে আলোচনায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন। চীন ওই দিন আসিয়ানের সঙ্গে তার মুক্তবাণিজ্য চুক্তির উন্নয়ন সংক্রান্ত এক নতুন চুক্তি সই করার পরিকল্পনা করছে, যা ডিজিটাল সেবা ও জলবায়ু প্রযুক্তি বাণিজ্য সহজ করবে।
ট্রাম্পের আগের মেয়াদে যেমন, তেমনই এবারও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নীতি প্রান্তিক বলেই মনে করা হচ্ছে। বাইডেনও তাঁর সময়ে বেশিরভাগ আঞ্চলিক বৈঠক এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দশটির মধ্যে নয়টি দেশ এখন চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

আঞ্চলিক ভারসাম্যে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা
অস্ট্রেলিয়ার লোয়ি ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের এই প্রভাব মূলত তার শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও ধারাবাহিক কূটনীতির ফল। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র এখন এই অঞ্চলে ‘প্রান্তিক উপস্থিতি’ মাত্র, বিশেষত যেসব দেশ ভৌগোলিকভাবে চীনের সন্নিকটে। ট্রাম্পের সাময়িক ও মনোযোগহীন এই সফর মার্কিন প্রভাব পুনরুদ্ধারের চেয়ে বরং তার অবক্ষয়কেই ত্বরান্বিত করতে পারে।
#ট্রাম্প #মালয়েশিয়া #কম্বোডিয়া #থাইল্যান্ড #আসিয়ান #দক্ষিণপূর্বএশিয়া #যুক্তরাষ্ট্র #চীন #শান্তিচুক্তি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















