ভুলে যাওয়া এক সুরকারের গল্প
১৮৬৯ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে জন্মেছিলেন সংগীত প্রতিভা উইল মেরিয়ন কুক। পড়াশোনা করেন ওবারলিন মিউজিক কনজারভেটরিতে, পরে ইউরোপে প্রশিক্ষণ নেন। এমনকি বিশ্ববিখ্যাত সুরকার আন্তোনিন দ্ভোরাকের কাছেও শিক্ষা নিয়েছিলেন। ১৮৯৩ সালে কার্নেগি হলে তাঁর এক পরিবেশনা এতটাই প্রশংসিত হয়েছিল যে এক সমালোচক তাঁকে ‘বিশ্বের সেরা কৃষ্ণাঙ্গ বেহালাবাদক’ বলেন। এতে ক্ষুব্ধ কুক উত্তর দেন—“আমি বিশ্বের সেরা কৃষ্ণাঙ্গ বেহালাবাদক নই, আমি বিশ্বের সেরা বেহালাবাদক।” এরপরই তিনি নিজের বেহালা ভেঙে ফেলেন এবং আর কখনো তা বাজাননি।
আমেরিকান সংগীতে নতুন ঢেউ
বেহালার পর তিনি মন দেন থিয়েটার সংগীতে। তখনকার ব্রডওয়ে ছিল ইউরোপীয় ঘরানার অনুকরণে একঘেয়ে। দ্ভোরাক পরামর্শ দিয়েছিলেন, আমেরিকার সংগীতকে তাদের শিকড় খুঁজে নিতে হবে। কুক তাই দাসপ্রথার সময়কার কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীত—সিঙ্কোপেশন, গসপেল ধাঁচের কোরাস ও ব্লুজ নোট—নিয়ে তৈরি করেন নতুন ছন্দ ও প্রাণবন্ত সংগীতনাট্য।
১৮৯৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বড় কাজ, ‘ক্লোরিন্ডি, অর দ্য অরিজিন অব দ্য কেকওয়াক’। কবি পল লরেন্স ডানবারের লেখা গানের সঙ্গে এই নাটক ছিল একেবারে নতুন ধারার সূচনা। সমালোচক ও শ্রোতারা বিস্মিত হন; জেমস ওয়েলডন জনসন পরে লিখেছিলেন, “ব্রডওয়ে প্রথমবার এমন কোরাস শুনল যা নিঃশ্বাস কাড়ে।”

কৃষ্ণাঙ্গ সংগীতের উত্থান
‘ক্লোরিন্ডি’-র সাফল্যের পর কুক তৈরি করেন অল-ব্ল্যাক ক্লেফ ক্লাব অর্কেস্ট্রা, যার ১৯১২ সালের কনসার্টে ছিল ১২৫ জন শিল্পী। পরে তা বেড়ে হয় ১৪৫ জন—৪৭টি ম্যান্ডোলিন, ১০টি পিয়ানোসহ এক অনন্য দল। তিনি ডিউক এলিংটন ও র্যাগটাইম পিয়ানিস্ট ইউবি ব্লেকের পরামর্শদাতা ছিলেন।
১৯২৯ সালে এক সংগীত নাট্যে রিহার্সাল পিয়ানিস্ট হিসেবে হাজির ছিলেন হ্যারল্ড আর্লেন। তাঁর একটি সুর শুনে কুক বলেন, “এটা পুরো গান বানাও।” সেই সুরই পরে হয় চিরসবুজ গান “গেট হ্যাপি।”
প্রতিভার আড়ালে দুঃখের ছায়া
কুকের ব্যক্তিজীবন ছিল অস্থির। ২৯ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন মাত্র ১৪ বছরের এক কিশোরীকে—বিবাহিত জীবন ব্যর্থ হয়। তাঁর মানসিক অবস্থা অস্থিতিশীল ছিল, কখনো অকারণে উচ্ছ্বসিত, কখনো গভীর বিষণ্ণতায় নিমগ্ন। জীবনের শেষ দিকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “অতিরিক্ত প্রশংসা ও সহজে উপার্জিত অর্থ আমাকে ৩৫ বছর ধরে সত্যিকারের শিল্পী হতে দেয়নি। এখন দেরি হয়ে গেছে।”
কৃষ্ণাঙ্গ ব্রডওয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্ত
কুকের সংগীতের মতোই আলোচনার দাবিদার ১৯২১ সালের ‘শাফল অ্যালং’—প্রথম ব্রডওয়ে মিউজিক্যাল যা জ্যাজের ছন্দে গড়া। ইউবি ব্লেক ও নোবেল সিসলের সুরে নাটকটি তৎকালীন সংগীত দুনিয়ায় এক বিদ্যুৎপ্রবাহ সৃষ্টি করে। “আই’ম জাস্ট ওয়াইল্ড অ্যাবাউট হ্যারি” ও “আই’ম সিম্পলি ফুল অব জ্যাজ”-এর মতো গান আজও জনপ্রিয়।
এর প্রভাবে জর্জ গার্শউইনের মতো সুরকারদের কাজেও আসে ব্লুজের ছোঁয়া। ‘শাফল অ্যালং’-এর পর থেকে কৃষ্ণাঙ্গ সংগীতই হয়ে ওঠে ব্রডওয়ের মূলধারা।

সুরকার ভোডেরি ও আমেরিকান মিউজিক্যালের বিকাশ
এই নাটকের সংগীত বিন্যাস করেছিলেন উইল ভোডেরি। তিনি ডিউক এলিংটনের অনুপ্রেরণা ছিলেন এবং পরবর্তীতে ‘শো বোট’-এর জন্য বিখ্যাত কোরাস তৈরি করেন। তাঁর সুর “মিজ’রি’স কামিন’ অ্যারাউন্ড” ছিল কৃষ্ণাঙ্গ দুঃখ ও সংগ্রামের সংগীতায়ন। সময়ের সংকটে তা বাদ পড়লেও তাঁর সুর করা “ওল’ ম্যান রিভার” আজও কিংবদন্তি।
পুনরাবিষ্কারের আহ্বান
২০১৬ সালে পরিচালক জর্জ সি. উলফ ‘শাফল অ্যালং’-এর আধুনিক রূপ মঞ্চস্থ করেন। কিন্তু মূল সুরগুলো কখনো রেকর্ড হয়নি। ২০১২ সালে কন্ডাক্টর রিক বেঞ্জামিন পুরনো অর্কেস্ট্রাল পার্টস খুঁজে বের করে কিছু রেকর্ড করেন, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ প্রকল্পের অর্থায়ন এখনো হয়নি।
এই সংগীতগুলো আবার শোনা দরকার—যেমন কুকের জীবন ও সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গ গবেষণাও দরকার। এসব কৃষ্ণাঙ্গ স্রষ্টার অবদান আমেরিকান সংগীতের মূল স্রোত গড়ে তুলেছে।

কৃষ্ণাঙ্গ ঐতিহ্যের নতুন পাঠ
লেখক জন ম্যাকহোয়ার্টার উল্লেখ করেন, এখনো এসব সংগীত ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছেন প্রধানত শ্বেতাঙ্গ গবেষকেরা। তবে তিনি মনে করেন, তাঁরা ইতিহাসকে মুছে ফেলছেন না, বরং পুনরুদ্ধার করছেন। এই প্রচেষ্টাই প্রমাণ করে—কৃষ্ণাঙ্গ সংগীত ঐতিহ্য এখন আর বিস্মৃত নয়, বরং আমেরিকার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অংশ হিসেবে ক্রমে পুনর্জীবিত হচ্ছে।
#BlackMusicRevolution #AfricanAmericanMusic #WillMarionCook #BroadwayHistory #JazzAndBlues #CulturalHeritage #AmericanMusic #Rediscovery #BlackComposers #HistoryOfMusic
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















