০৫:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫
বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থবির, উত্তরাঞ্চলে লোডশেডিংয়ে চরম ভোগান্তি বিএসসিআইসি শিল্প এলাকায় রঙ কারখানার বয়লার কক্ষে ভয়াবহ বিস্ফোরণ জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী তাকাইচির প্রথম পদক্ষেপ: ‘ক্যাশ রিলিফ’ আর দ্রুত সামরিক শক্তি সীমান্ত বাণিজ্য থমকে যাওয়ায় নীরব দর্শনা রেলওয়ে স্টেশন কোরিয়ান হিট ‘হাউস অব ডায়নামাইট’: শুধু ড্রামা নয়, সাউন্ডট্র্যাকও হচ্ছে আলাদা ব্যবসা কেনিয়ার মাসাই মারায় একা বেঁচে থাকা চিতা শাবককে ঘিরে তর্ক: বাঁচানো নাকি বশ মানানো? অ্যাপলের আইওএস ফাঁসকাণ্ডে লিকার প্রসরের বিরুদ্ধে ডিফল্ট অর্ডার, এখন ঝুঁকিতে পুরো ‘লিক কালচার রুশ ড্রোন হামলায় কিয়েভে মা-মেয়ে নিহত, অন্তত ২৯ জন আহত আসিয়ানে থাই-কাম্বোডিয়া সীমান্ত যুদ্ধবিরতি, ট্রাম্পের সামনে চুক্তি বাংলাদেশ-পাকিস্তান সহযোগিতায় নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত

পর্যটকদের জন্য সাজানো স্প্রিটজ ও পাস্তা সংস্কৃতি কি শহরের আসল চেহারা বদলে দিচ্ছে?

খাবারের শহরে রূপ নিচ্ছে ইতালি

সিসিলির রাজধানী পালেরমোর কেন্দ্রে ভিয়া মাকুয়েদা রাস্তায় একের পর এক রেস্তোরাঁ। আরানচিনি, ক্যানোলি, এপেরল স্প্রিটজ — সব মিলিয়ে যেন এক উৎসবমুখর খাবারের শহর। কিন্তু এই “খাবারের দুনিয়া” এখন স্থানীয়দের জন্য এক অস্বস্তির কারণ।

অস্ট্রেলিয়ান পর্যটক মার্ক স্মিথ বললেন, “এই রাস্তা অসাধারণ। একটার পর একটা রেস্তোরাঁ। সত্যিই দারুণ!” কিন্তু শহরের মেয়র রোবের্তো লাগাল্লা মনে করেন, আনন্দের এ উচ্ছ্বাসে শহরের বাস্তব জীবন হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি ভিয়া মাকুয়েদা ও আশপাশের এলাকায় নতুন রেস্তোরাঁ খোলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তাঁর মন্তব্য—“অতিরিক্ত মিষ্টি যেমন কফির স্বাদ নষ্ট করে, তেমনি অতিরিক্ত খাবার শহরের প্রাণ নষ্ট করছে।”


পর্যটন-নির্ভর অর্থনীতি ও স্থানীয় জীবনের সংকট

ইতালির বেশ কয়েকটি শহর—বোলোনিয়া, ফ্লোরেন্স, রোম, তুরিন—এখন একপ্রকার “খোলা রেস্তোরাঁয়” পরিণত হয়েছে। পর্যটকদের মন ভোলাতে নারীদেরকে দিয়ে জানালার সামনে পাস্তা বানানোর প্রদর্শনী, ইনস্টাগ্রাম-নির্ভর খাবার পরিবেশন—সব মিলিয়ে শহরগুলো যেন নিজেকেই অনুকরণ করছে।

ফ্লোরেন্সের প্রশাসনও ৫০টির বেশি রাস্তায় নতুন রেস্তোরাঁ নিষিদ্ধ করেছে। সমালোচকদের ভাষায়, এটি এখন “একটা বিনোদন পার্ক, শহর নয়।” পালেরমোর সমাজকর্মী কারেন বাসিল বলেন, “এই উচ্ছ্বাসের পেছনে শহরের আসল জীবন হারিয়ে যাচ্ছে।”


নগর জীবনের পরিবর্তন

গত দশ বছরে পর্যটনের চাপে ইতালির ঐতিহাসিক শহরকেন্দ্রগুলোর রূপ পাল্টে গেছে। রোমের কেন্দ্রে গত ১৫ বছরে জনসংখ্যা এক-চতুর্থাংশ কমেছে, ভেনিস ও ফ্লোরেন্সেও একই প্রবণতা। এখন শহরগুলো দিন দিন পর্যটনের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠছে—যা দেশের মোট অর্থনীতির প্রায় ১৩ শতাংশ। শুধু খাবার ও ওয়াইনভিত্তিক পর্যটনই গত দশকে তিনগুণ বেড়েছে।

নগরের সরু অলিগলিতে এখন ক্রমবর্ধমান বেড-অ্যান্ড-ব্রেকফাস্ট সাইনবোর্ড, গলফ কার, পর্যটকের ভিড় ও লিমোচেলো-তিরামিসু দোকানের সারি। ঐতিহ্যবাহী বাজারের ফল-মাছের দোকান হারিয়ে গেছে এই খাবার-কেন্দ্রিক অর্থনীতির জোয়ারে।


“ফুডিফিকেশন” ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতাকে বলা হচ্ছে “ফুডিফিকেশন”—খাবারনির্ভর গেন্ট্রিফিকেশন বা নগর রূপান্তর। পালেরমোতে ২০১৫ সালে ইউনেসকোর স্বীকৃতির পর পর্যটন দ্রুত বেড়েছে। ২০২৪ সালে শহরে আগত পর্যটকের সংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে — পাঁচ বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, পর্যটকের চাহিদা মেটাতে প্রচলিত দোকানগুলো দ্রুত রেস্তোরাঁয় রূপান্তরিত হচ্ছে, কারণ এটি অনেক বেশি লাভজনক। শহরের নগর পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তা মরিজিও কার্তা বলেন, “এটা যেন এমন এক বাজার যেখানে ক্রেতাদের রুচি নেই, চোখ নেই—ব্যবসায়ীরা শুধু সুযোগ নিচ্ছে।”


উন্নয়ন না অবক্ষয়?

পালেরমোর সমাজকর্মী বাসিলের মতে, “এ যেন পম্পেইয়ের শেষ দিনগুলো—সবাই খাচ্ছে, গাইছে, অথচ বিপর্যয় কাছে।” তরুণ বেকারত্ব ও মেধাপ্রবাহের কারণে দেশ ছাড়ার প্রবণতা বাড়লেও, পর্যটন এখনো অনেকের জীবিকার উৎস। প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি সম্প্রতি বলেছেন, “পর্যটনই আমাদের ধন ও সমৃদ্ধির উৎস।”

শহরের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, পর্যটন উন্নয়নের ফলে পুরনো যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলো নতুন রূপ পাচ্ছে। পালেরমোর পর্যটন বিভাগের প্রধান আলেসান্দ্রো আনেলো বলেন, “শহর এখন আগের চেয়ে সুন্দর ও নিরাপদ।”


দ্বন্দ্বের মাঝেই বাস্তবতা

পর্যটন যেমন আয় বাড়িয়েছে, তেমনি ভাড়া ও খরচও বাড়িয়েছে। ট্যুর গাইড ভ্যালেরিয়া ভিত্রানো বলেন, “আমার সবজি বিক্রেতা এখন রেস্তোরাঁ চালাচ্ছে, আর বন্ধুরা ভাড়ার চাপে শহর ছেড়ে যাচ্ছে।” তবুও তিনি স্বীকার করেন, “এই পর্যটনই আমার জীবিকা। এটিই দ্বন্দ্ব।”

পালেরমোর ক্যাপো মার্কেটে এখন স্থানীয়দের জন্য নয়, পর্যটকদের জন্য সাজানো খাবার—স্পাইরাল পাস্তা, ক্যানোলি আকৃতির মিষ্টি, ভাজা স্ট্রিট ফুড। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, তারা এখন কর্পোরেট কনফারেন্স ও ডিজিটাল নোম্যাডদের আকৃষ্ট করতে চায়, আর রেস্তোরাঁর সংখ্যা সীমিত রেখে শহরের ভারসাম্য রক্ষা করবে।

স্লোভেনীয় ছাত্র গাসপার বেরভার এক গ্লাস স্প্রিটজ হাতে বললেন, “সাধারণত আমি বিয়ার খাই, কিন্তু সিসিলিতে এসে স্প্রিটজ না খেলে কেমন লাগে?”


ইতালির শহরগুলো আজ এক অনন্য সংকটে—খাবার ও পর্যটনের আনন্দে ভেসে যাচ্ছে তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্থানীয় জীবন। একদিকে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, অন্যদিকে শহর হারাচ্ছে তার আত্মা। প্রশ্ন রয়ে যায়, ইতালি কি আবার তার সত্যিকারের স্বাদ ফিরে পাবে?

জনপ্রিয় সংবাদ

বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থবির, উত্তরাঞ্চলে লোডশেডিংয়ে চরম ভোগান্তি

পর্যটকদের জন্য সাজানো স্প্রিটজ ও পাস্তা সংস্কৃতি কি শহরের আসল চেহারা বদলে দিচ্ছে?

০১:৫৩:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫

খাবারের শহরে রূপ নিচ্ছে ইতালি

সিসিলির রাজধানী পালেরমোর কেন্দ্রে ভিয়া মাকুয়েদা রাস্তায় একের পর এক রেস্তোরাঁ। আরানচিনি, ক্যানোলি, এপেরল স্প্রিটজ — সব মিলিয়ে যেন এক উৎসবমুখর খাবারের শহর। কিন্তু এই “খাবারের দুনিয়া” এখন স্থানীয়দের জন্য এক অস্বস্তির কারণ।

অস্ট্রেলিয়ান পর্যটক মার্ক স্মিথ বললেন, “এই রাস্তা অসাধারণ। একটার পর একটা রেস্তোরাঁ। সত্যিই দারুণ!” কিন্তু শহরের মেয়র রোবের্তো লাগাল্লা মনে করেন, আনন্দের এ উচ্ছ্বাসে শহরের বাস্তব জীবন হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি ভিয়া মাকুয়েদা ও আশপাশের এলাকায় নতুন রেস্তোরাঁ খোলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তাঁর মন্তব্য—“অতিরিক্ত মিষ্টি যেমন কফির স্বাদ নষ্ট করে, তেমনি অতিরিক্ত খাবার শহরের প্রাণ নষ্ট করছে।”


পর্যটন-নির্ভর অর্থনীতি ও স্থানীয় জীবনের সংকট

ইতালির বেশ কয়েকটি শহর—বোলোনিয়া, ফ্লোরেন্স, রোম, তুরিন—এখন একপ্রকার “খোলা রেস্তোরাঁয়” পরিণত হয়েছে। পর্যটকদের মন ভোলাতে নারীদেরকে দিয়ে জানালার সামনে পাস্তা বানানোর প্রদর্শনী, ইনস্টাগ্রাম-নির্ভর খাবার পরিবেশন—সব মিলিয়ে শহরগুলো যেন নিজেকেই অনুকরণ করছে।

ফ্লোরেন্সের প্রশাসনও ৫০টির বেশি রাস্তায় নতুন রেস্তোরাঁ নিষিদ্ধ করেছে। সমালোচকদের ভাষায়, এটি এখন “একটা বিনোদন পার্ক, শহর নয়।” পালেরমোর সমাজকর্মী কারেন বাসিল বলেন, “এই উচ্ছ্বাসের পেছনে শহরের আসল জীবন হারিয়ে যাচ্ছে।”


নগর জীবনের পরিবর্তন

গত দশ বছরে পর্যটনের চাপে ইতালির ঐতিহাসিক শহরকেন্দ্রগুলোর রূপ পাল্টে গেছে। রোমের কেন্দ্রে গত ১৫ বছরে জনসংখ্যা এক-চতুর্থাংশ কমেছে, ভেনিস ও ফ্লোরেন্সেও একই প্রবণতা। এখন শহরগুলো দিন দিন পর্যটনের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠছে—যা দেশের মোট অর্থনীতির প্রায় ১৩ শতাংশ। শুধু খাবার ও ওয়াইনভিত্তিক পর্যটনই গত দশকে তিনগুণ বেড়েছে।

নগরের সরু অলিগলিতে এখন ক্রমবর্ধমান বেড-অ্যান্ড-ব্রেকফাস্ট সাইনবোর্ড, গলফ কার, পর্যটকের ভিড় ও লিমোচেলো-তিরামিসু দোকানের সারি। ঐতিহ্যবাহী বাজারের ফল-মাছের দোকান হারিয়ে গেছে এই খাবার-কেন্দ্রিক অর্থনীতির জোয়ারে।


“ফুডিফিকেশন” ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতাকে বলা হচ্ছে “ফুডিফিকেশন”—খাবারনির্ভর গেন্ট্রিফিকেশন বা নগর রূপান্তর। পালেরমোতে ২০১৫ সালে ইউনেসকোর স্বীকৃতির পর পর্যটন দ্রুত বেড়েছে। ২০২৪ সালে শহরে আগত পর্যটকের সংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে — পাঁচ বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, পর্যটকের চাহিদা মেটাতে প্রচলিত দোকানগুলো দ্রুত রেস্তোরাঁয় রূপান্তরিত হচ্ছে, কারণ এটি অনেক বেশি লাভজনক। শহরের নগর পরিকল্পনা বিভাগের কর্মকর্তা মরিজিও কার্তা বলেন, “এটা যেন এমন এক বাজার যেখানে ক্রেতাদের রুচি নেই, চোখ নেই—ব্যবসায়ীরা শুধু সুযোগ নিচ্ছে।”


উন্নয়ন না অবক্ষয়?

পালেরমোর সমাজকর্মী বাসিলের মতে, “এ যেন পম্পেইয়ের শেষ দিনগুলো—সবাই খাচ্ছে, গাইছে, অথচ বিপর্যয় কাছে।” তরুণ বেকারত্ব ও মেধাপ্রবাহের কারণে দেশ ছাড়ার প্রবণতা বাড়লেও, পর্যটন এখনো অনেকের জীবিকার উৎস। প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি সম্প্রতি বলেছেন, “পর্যটনই আমাদের ধন ও সমৃদ্ধির উৎস।”

শহরের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, পর্যটন উন্নয়নের ফলে পুরনো যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলো নতুন রূপ পাচ্ছে। পালেরমোর পর্যটন বিভাগের প্রধান আলেসান্দ্রো আনেলো বলেন, “শহর এখন আগের চেয়ে সুন্দর ও নিরাপদ।”


দ্বন্দ্বের মাঝেই বাস্তবতা

পর্যটন যেমন আয় বাড়িয়েছে, তেমনি ভাড়া ও খরচও বাড়িয়েছে। ট্যুর গাইড ভ্যালেরিয়া ভিত্রানো বলেন, “আমার সবজি বিক্রেতা এখন রেস্তোরাঁ চালাচ্ছে, আর বন্ধুরা ভাড়ার চাপে শহর ছেড়ে যাচ্ছে।” তবুও তিনি স্বীকার করেন, “এই পর্যটনই আমার জীবিকা। এটিই দ্বন্দ্ব।”

পালেরমোর ক্যাপো মার্কেটে এখন স্থানীয়দের জন্য নয়, পর্যটকদের জন্য সাজানো খাবার—স্পাইরাল পাস্তা, ক্যানোলি আকৃতির মিষ্টি, ভাজা স্ট্রিট ফুড। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, তারা এখন কর্পোরেট কনফারেন্স ও ডিজিটাল নোম্যাডদের আকৃষ্ট করতে চায়, আর রেস্তোরাঁর সংখ্যা সীমিত রেখে শহরের ভারসাম্য রক্ষা করবে।

স্লোভেনীয় ছাত্র গাসপার বেরভার এক গ্লাস স্প্রিটজ হাতে বললেন, “সাধারণত আমি বিয়ার খাই, কিন্তু সিসিলিতে এসে স্প্রিটজ না খেলে কেমন লাগে?”


ইতালির শহরগুলো আজ এক অনন্য সংকটে—খাবার ও পর্যটনের আনন্দে ভেসে যাচ্ছে তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্থানীয় জীবন। একদিকে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, অন্যদিকে শহর হারাচ্ছে তার আত্মা। প্রশ্ন রয়ে যায়, ইতালি কি আবার তার সত্যিকারের স্বাদ ফিরে পাবে?