লন্ডনের ধাতব ভোজসভা ও বাজারের উচ্ছ্বাস
প্রতি অক্টোবরে লন্ডন মেটাল এক্সচেঞ্জের (এলএমই) আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এক জাঁকজমকপূর্ণ ডিনার। ঝলমলে ঝাড়বাতির নিচে ১,৫০০ অতিথি কালো টাই পরিহিত অবস্থায় আলোচনায় মেতে ওঠেন, সেলফি তোলেন এবং হাস্যরস উপভোগ করেন। ভিআইপি টেবিলে খনি ব্যবসায়ী ও মন্ত্রীরা ওয়াইনের গ্লাস হাতে চুক্তি সম্পন্ন করেন।
তবে সবচেয়ে বড় উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে তামার বাজারে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত আমদানি শুল্ক আমেরিকার অ্যালুমিনিয়াম, তামা ও ইস্পাত বাজারে বড় ধরনের ‘আর্বিট্রাজ’ সুযোগ তৈরি করেছে। ফলে লন্ডনে তামার দাম টনপ্রতি ১০,৬০০ ডলারেরও বেশি, যা গত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এই দাম বৃদ্ধির ফলে অ্যাঙ্গলো আমেরিকান ও টেক রিসোর্সেস নামের দুই খনি কোম্পানির মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের একীভূতকরণ চুক্তি হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় খনি কোম্পানি বিএইচপি বন্ধ খনি পুনরায় চালুর চিন্তা করছে। এমনকি সৌদি আরামকোও এখন তামা ব্যবসায় নতুন ট্রেডার নিয়োগ দিচ্ছে।

অর্থনীতি স্থবির, তবুও তামা এত দামী কেন?
তামা বাজারে এই উন্মাদনা সময়ের তুলনায় অদ্ভুত। “ডক্টর কপার” নামে পরিচিত এই ধাতুটি সাধারণত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। অথচ এখন বিশ্বের অর্থনীতি তেমন গতি না থাকলেও তামার দাম ঊর্ধ্বমুখী।
বিশ্লেষকেরা এর তিনটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন—বর্ধিত চাহিদা, সীমিত সরবরাহ অথবা অর্থনৈতিক নীতির প্রভাব।
চাহিদার যুক্তি: জ্বালানি রূপান্তর ও এআই প্রযুক্তি
তামার দাম বৃদ্ধির পেছনে অনেক বিনিয়োগকারী যুক্তি দিচ্ছেন যে এটি জ্বালানি রূপান্তর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) শিল্পের অপরিহার্য উপাদান।
একটি বৈদ্যুতিক গাড়িতে সাধারণ গাড়ির তুলনায় দুই থেকে চার গুণ বেশি তামা লাগে। বিদ্যুৎ গ্রিড ও বায়ু টারবাইনেও তামার ব্যাপক ব্যবহার হয়। নতুন ডেটা সেন্টারগুলোই এই বছর প্রায় ৩ লাখ টন পরিশোধিত তামা ব্যবহার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় ১ শতাংশ।
তবে বিশ্লেষকেরা মনে করিয়ে দেন, এই যুক্তি নতুন নয়। “তামার ঘাটতি আসছে”—এই পূর্বাভাস তারা গত কয়েক বছর ধরেই শুনছেন। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে তামার ব্যবহারও ক্রমে দক্ষ হচ্ছে; যেমন, ২০২৫ সালের একটি ইলেকট্রিক গাড়িতে ২০২০ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ কম তামা প্রয়োজন।

অন্যদিকে, তামার বড় ক্রেতা চীন বর্তমানে নির্মাণ-খাতনির্ভর অর্থনীতি থেকে সরে আসছে, ফলে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন তামার চাহিদা কমে যেতে পারে বলে অনুমান করছেন প্যানমিউর লিবারামের বিশ্লেষক টম প্রাইস।
সরবরাহের ঘাটতি: দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব
তামার দামের আরেক কারণ হতে পারে সরবরাহ ঘাটতি। ৮ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ার গ্রাসবার্গ খনিতে ভূমিধসের পর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই খনি ২০২৭ সালের আগে পুরোপুরি উৎপাদনে ফিরবে না বলে জানিয়েছে এর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ফ্রিপোর্ট।
এ ছাড়া চিলি ও কঙ্গোর বিভিন্ন খনিতে বিঘ্ন ঘটায় ২০২৫ সালে প্রায় ৪ লাখ টন তামা সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। ফ্রিপোর্ট ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রাসবার্গ খনিতে ‘ফোর্স মাজর’ ঘোষণার পরই তামার দাম ৪ শতাংশ বেড়ে যায়। তবুও এসব দুর্ঘটনা বিশ্ববাজারে তামার ঘাটতি সৃষ্টির মতো বড় নয়; শিল্পের সাধারণ ‘বাধা অনুমান’ হিসাবেই এগুলো ধরা হচ্ছে। বরং চিলির এসকনদিদা খনি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি উৎপাদন করছে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি: প্রকৃত চালক
সবশেষে রয়ে যায় তৃতীয় কারণ—রাজনৈতিক অর্থনীতি। জুলাই মাসে আমেরিকা তামা আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। জানুয়ারি থেকেই নিউইয়র্কে তামার দাম লন্ডনের তুলনায় দ্রুত বাড়ছিল; নতুন শুল্কের ঘোষণায় তা আরও রেকর্ড ছোঁয়।
আগস্টে ট্রাম্প পরিশোধিত তামাকে শুল্কমুক্ত ঘোষণা করলে দাম সাময়িকভাবে কমে, তবে নতুন শুল্কের গুজবে আবার বেড়ে যায়। ফলে নিউইয়র্কে বিপুল পরিমাণ মজুদ জমে গেছে—এখন সেখানে প্রায় ৩.৪ লাখ টন তামা পড়ে আছে, জানুয়ারির ৮০ হাজার টনের তুলনায় চার গুণেরও বেশি।

বিনিয়োগপ্রবাহ ও বৈশ্বিক প্রভাব
লন্ডনের দামের ওপর এসব বিকৃতি তেমন প্রভাব ফেলছে না, কারণ সেটিই বৈশ্বিক মানদণ্ড। মার্কিন অর্থনীতি মন্থর হওয়ায় ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমিয়েছে, এতে ডলারের মানও হ্রাস পেয়েছে। ডলারে মূল্য নির্ধারিত পণ্যের দাম তাই বড় বিনিয়োগ তহবিলগুলোর কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, এবং তারা ২০২০ সাল থেকে তামা বাজারে প্রবেশ করছে।
তবে এসব ‘ট্যুরিস্ট বিনিয়োগকারী’ সরবরাহ-চাহিদার সূক্ষ্ম ভারসাম্যে তেমন নজর দেয় না; তাদের মূল আগ্রহ সুদের হারে। এতে তামার দামের স্থিতিশীলতা কৃত্রিমভাবে দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
কিন্তু যদি চীনের অর্থনৈতিক মন্দা আরও গভীর হয় বা অতিরিক্ত শুল্কের ফলে তামার চাহিদা ভেঙে পড়ে, তাহলে বাজারে বড় ধাক্কা আসতে পারে। সেই সময় হয়তো তামার এই জমজমাট উৎসব শেষ হবে এক ভয়ানক হ্যাংওভারের মধ্য দিয়ে।
#তামা_বাজার #ট্রাম্প_নীতি #বিশ্বঅর্থনীতি #জ্বালানি_রূপান্তর #চীন_অর্থনীতি
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















