অর্থনৈতিক সাফল্যের পেছনে রাজনৈতিক সংকটের ছায়া
তানজানিয়া ও আইভরি কোস্ট—দুই দেশই তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে অর্থনৈতিক অগ্রগতির উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি কোস্টে চলছে এক ধরনের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ, আর পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়ায় গত দুই দশক ধরে বার্ষিক গড় ৬ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বজায় রয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি তুলনামূলকভাবে কম এবং সরকারি ঋণের বোঝাও নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
তবে এ মাসে যখন দুই দেশের জনগণ নির্বাচনের মুখোমুখি, তখন তাদের শাসকরা সবচেয়ে বেশি যেটি তুলে ধরছেন তা হলো “স্থিতিশীলতা”—যা তারা উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে দেখাচ্ছেন। আইভরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট আলাসান ওয়াতারা তার ৮৩ বছর বয়সেও দাবি করছেন, দেশকে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাঁর অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। তাই সংবিধানবিরোধী চতুর্থ মেয়াদের নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তানজানিয়ার শাসক দল সিসিএম—যা ১৯৬১ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই ক্ষমতায়—একই যুক্তি ব্যবহার করছে। প্রেসিডেন্ট সামিয়া সুলুহু হাসানও প্রথমবারের মতো নির্বাচনে যাচ্ছেন এবং কিছুই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন না।

প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন ও আইনি কৌশল
দুই দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে ক্ষমতা প্রায় পুরোপুরি নির্বাহী শাখায় কেন্দ্রীভূত। ফলে প্রতিটি নির্বাচনের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং সহিংসতার আশঙ্কাও থাকে। উভয় দেশেই শাসক দলগুলোর প্রভাব বিচারবিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রবল। বিরোধীদের অংশগ্রহণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তানজানিয়ায় এই দমননীতি সবচেয়ে সুস্পষ্ট। প্রেসিডেন্ট নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন কমিশন মূল বিরোধী দল চাদেমাকে সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিতে নিষিদ্ধ করেছে। দলের নেতা টুন্ডু লিসু রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত, যার রায় নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর ঘোষণা হবে—অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক সময়েই। তাঁর ভাই ভিনসেন্ট মুঘওয়াই বলেন, “সবকিছুই সাজানো নাটক।” তানজানিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল ACT-ওয়াজালেন্দোর নেতা ‘প্রক্রিয়াগত কারণে’ অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন।
আইভরি কোস্টেও একই কৌশল দেখা যাচ্ছে। মোট ৫৫ জন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট লরেন্ট গবাগবো ও ক্রেডিট সুইসের সাবেক প্রধান তিজানে থিয়াম—যারা ওয়াতারার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারতেন। আদালত থিয়ামকে প্রার্থিতা থেকে বিরত রেখেছে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত এক আইনি জটিলতার অজুহাতে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এমন সিদ্ধান্তগুলো প্রায় সবসময়ই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কাজ করে।
নির্বাচনের আগে দমননীতি ও নিরাপত্তা হুমকি
ওয়াতারা এখনও দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে জনপ্রিয়, কারণ গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কৃতিত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তাঁর সরকারের কঠোর মনোভাবকেই প্রমাণ করছে। অক্টোবরের ১৭ তারিখে সরকার দুই মাসের জন্য সব রাজনৈতিক সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। এক সপ্তাহে প্রায় ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; অভিযোগ, তারা “রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড” পরিকল্পনা করছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ৪৪ হাজার পুলিশ ও সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

তবে তানজানিয়ার পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। সাংবাদিক এরিক কাবেন্দেরার মতে, সরকার আশঙ্কা করছে “জেন জি প্রজন্মের” তরুণদের কোনো গণআন্দোলন শুরু হতে পারে, যেমনটি সম্প্রতি মাদাগাস্কার ও কেনিয়ায় দেখা গেছে। তাই দেশটিতে ১৯৯০-এর দশকে বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তনের পর এত ব্যাপক দমননীতি আর দেখা যায়নি। গত কয়েক মাসে বহু তরুণ ও বিরোধী কর্মী নিখোঁজ হয়েছেন। ৬ অক্টোবর ক্ষমতাসীন দলের এক সাবেক নেতা, যিনি সরকারের সমালোচনা করেছিলেন, তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ২২ অক্টোবর চাদেমার উপ-চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করা হয় আদালতে উপস্থিত হওয়ার সময়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আড়ালে সামাজিক বৈষম্য
দীর্ঘস্থায়ী প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও তানজানিয়ার শাসক দল সিসিএম তাদের অর্ধশতাব্দীর শাসনের বাস্তব সাফল্য দেখাতে পারছে না। দারিদ্র্য হ্রাসে অগ্রগতি ধীর, এবং আয়-বৈষম্য বাড়ছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে বাণিজ্যিক রাজধানী দার এস সালামে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। অসন্তুষ্ট নাগরিক ও ভিন্নমতাবলম্বীরা নির্বাচনের দিন গণবিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন।
তানজানিয়া ও আইভরি কোস্ট উভয় দেশই নিজেদের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, বিরোধী কণ্ঠ দমন এবং নাগরিক স্বাধীনতার সংকোচনের কারণে এই স্থিতিশীলতা ভেতরে ভেতরে ভঙ্গুর হয়ে উঠছে। আফ্রিকায় উন্নয়নের মডেল হিসেবে নয়, বরং সতর্কবার্তা হিসেবে এই দুই দেশ এখন সামনে আসছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















