অজানা প্রাণীর অস্তিত্বে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি
আইডাহো স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যানাটমি ও নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক জেফরি মেলড্রাম ছিলেন এমন এক বিজ্ঞানী, যিনি বিগফুট বা ‘স্যাসকোয়াচ’ নিয়ে কেবল বিশ্বাস নয়, বরং গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ খুঁজেছেন। তাঁর মতে, এটি কোনো লোককাহিনির চরিত্র নয়, বরং মানবজাতির বিলুপ্ত না হওয়া এক আত্মীয় প্রজাতি—যেমন নিয়ানডারথাল বা হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস।
মেলড্রাম বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া তথাকথিত বিগফুটের পদচিহ্নের ত্রিমাত্রিক স্ক্যান বিশ্লেষণ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন, এসব ছাপ মানুষের পায়ের ছাপের সঙ্গে মেলে না, বরং এদের মধ্যে একটি অভিন্ন গঠন রয়েছে। বিশেষ করে পদতলের মাঝের স্থিতিস্থাপক গঠন এবং সামনের অংশের বিস্তৃতি ছিল বনমানুষদের মতো। তিনি বলেছিলেন, “যদি এগুলো প্রতারণা হয়, তবে তা এক অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা, যা হয়তো কেবল আমার মতো গবেষকের জন্যই তৈরি।”
জীবনের শুরু ও আগ্রহের সূত্রপাত
ডন জেফরি মেলড্রাম ১৯৫৮ সালের ২৪ মে সল্ট লেক সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব কেটেছে ওরেগন অঙ্গরাজ্য ও ওয়াশিংটনে, যেখানে তিনি প্রজাপতি ও সাপ ধরে সময় কাটাতেন।
মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি প্রথম বিখ্যাত ‘প্যাটারসন–গিমলিন’ চলচ্চিত্র দেখেন—যেখানে এক অজানা প্রাণীকে জঙ্গলে হাঁটতে দেখা যায়। সেই মুহূর্ত থেকেই তাঁর কৌতূহল জন্ম নেয়।

তবে পরবর্তী সময়ে তিনি প্রচলিত বিজ্ঞানের পথে এগোন। ব্রিগহাম ইয়াং ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাণিবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং নিউইয়র্কের স্টনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৯ সালে পিএইচডি অর্জন করেন। পরে ডিউক ও নর্থওয়েস্টার্ন মেডিকেল স্কুলে শিক্ষকতা করেন এবং ১৯৯৩ সালে আইডাহো স্টেটে যোগ দেন।
পুনরায় বিগফুটের পথে
১৯৯৬ সালে এক অপেশাদার গবেষক তাঁকে ওয়াশিংটনের ব্লু মাউন্টেন এলাকায় কাদামাটিতে পাওয়া পদচিহ্ন দেখাতে ডাকেন। মেলড্রাম প্রথমে প্রতারণা ভেবেছিলেন, কিন্তু প্রায় পঁয়ত্রিশটি বিশাল পদচিহ্ন দেখে তিনি হতবাক হয়ে যান। পরে তিনি বলেছিলেন, “সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এক দেবদূত বলছে, ‘এই পথে যেও না,’ আর অন্য কণ্ঠ বলছে, ‘কিন্তু কীভাবে যাব না?’”
এরপর থেকে তিনি পুরোপুরি এই গবেষণায় নিবেদিত হন। নিজের ল্যাবে ৩০০টিরও বেশি পদচিহ্নের ছাঁচ সংগ্রহ করেন এবং একটি উন্মুক্ত ত্রিমাত্রিক তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেন। নানা জায়গা থেকে সংগৃহীত চুলের নমুনা তিনি ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠান, যদিও চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
একাডেমিক বিতর্ক ও সম্মান
.jpg)
মেলড্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত বিজ্ঞান বিষয়ক ক্লাস নিতেন, তবে বিগফুট ছিল তাঁর মূল গবেষণার বিষয়। এতে সহকর্মীদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। ২০০৬ সালে ‘নিউজডে’ পত্রিকা তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য প্রকাশ করে। তবে তাঁর বিভাগের চেয়ারম্যান জ্যানেট লক্সটারম্যান বলেন, “তিনি কখনো বিতর্কপ্রবণ ছিলেন না, বরং বিনয়ী ও সহকর্মীদের প্রিয় ছিলেন, যদিও সবাই তাঁর গবেষণাকে সমর্থন করতেন না।”
অন্যদিকে, বিগফুট গবেষণা সমাজে মেলড্রাম ছিলেন এক নায়ক। ক্লিফ বারাকম্যান নামে এক গবেষক বলেন, “এই বিষয়ের চারপাশে অনেক অদ্ভুত মানুষ ঘোরে, কিন্তু মেলড্রাম ছিলেন এর এক গম্ভীর, বিজ্ঞ প্রতিনিধি। তাঁর সমালোচকরাও বলতে পারতেন কেবল: তিনি ভুল, কিন্তু পাগল নন।”
বৈজ্ঞানিক প্রভাব ও উত্তরাধিকার
জেইন গুডল নিজেও বিগফুটে বিশ্বাস করতেন এবং মেলড্রামের বই ‘স্যাসকোয়াচ: লেজেন্ডস মিট সায়েন্স’ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে এটি “প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের নতুন মানদণ্ড স্থাপন করেছে।”
মেলড্রাম একবার বলেছিলেন, “আমি কাউকে বোঝাতে চাই না যে বিগফুট আছে; আমি কেবল কিংবদন্তিকে বৈজ্ঞানিক যাচাইয়ের মুখে আনছি, এবং আমার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট—বিগফুট সত্যিই বিদ্যমান।”
জেফ মেলড্রাম ২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মস্তিষ্কের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন একমাত্র স্থায়ী পদে নিযুক্ত একাডেমিক, যিনি সারাজীবন এই অজানা প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা চালিয়ে গেছেন—একজন বিজ্ঞানী, যিনি কল্পকাহিনির জগতে মিশিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের দৃঢ়তা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















