মিয়ানমার থেকে বৃহৎ পালিয়ে যাওয়া কর্মী দল
মিয়ানমারে সেনা অভিযানের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় সাইবার প্রতারণা কেন্দ্রগুলোর একটিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এই অভিযানের পর অন্তত এক হাজারের বেশি মানুষ থাইল্যান্ডে পালিয়েছে, যাদের মধ্যে শতাধিক ভারতীয় নাগরিকও রয়েছেন বলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।
থাই গণমাধ্যম খাওসোদ জানায়, সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া প্রায় ৩৯৯ জন ভারতীয় নাগরিকের তথ্য পাওয়া গেছে, যা এককভাবে সবচেয়ে বড় বিদেশি দল। যদিও এই সংখ্যা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।
‘কেকে পার্ক’ থেকে পলায়ন
এই কর্মীরা মূলত মিয়ানমারের কুখ্যাত কেকে পার্ক (KK Park) থেকে পালিয়ে আসে, যা থাইল্যান্ডের সীমান্তঘেঁষা কারেন রাজ্যে অবস্থিত। বুধবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত চলা এই পলায়নের ঘটনাটি নিশ্চিত করেছে থাই প্রাদেশিক প্রশাসন।
কেকে পার্কের মতো বিশাল কম্পাউন্ডগুলোতে হাজার হাজার কর্মীকে রাখা হয়, যারা মূলত অনলাইন প্রতারণা বা ‘সাইবার স্ক্যাম’-এর সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো “পিগ বাচারিং” প্রতারণা, যেখানে প্রতারকেরা দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধুত্ব বা প্রেমের ভান করে ভুক্তভোগীকে ভুয়া ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করে।

এই কর্মকাণ্ডে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় জড়ালেও অনেকেই মানব পাচারের শিকার—মিথ্যা চাকরির প্রলোভনে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে সশস্ত্র প্রহরায় আটকে রেখে জোরপূর্বক প্রতারণায় নিযুক্ত করা হয়। অবাধ্য হলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
সীমান্তে মানবিক সংকট ও তদন্ত
থাইল্যান্ডের তাক প্রদেশের উপ-গভর্নর সাওয়ানিত সুরিয়াকুল না আয়ুথায়া জানিয়েছেন, সীমান্ত পেরিয়ে আসা ব্যক্তিদের মানব পাচারের শিকার কি না, তা যাচাই করা হবে। যদি তা না হয়, তবে অবৈধ সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
থাই কর্তৃপক্ষ সীমান্ত এলাকায় একাধিক চেকপোস্ট স্থাপন করেছে এবং মানবিক সহায়তা হিসেবে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। থাই ইমিগ্রেশন ব্যুরোর মুখপাত্র পুলিশ লেফটেন্যান্ট জেনারেল চোএংরন রিমপাডি জানিয়েছেন, আগতদের পরিচয় ও অপরাধমূলক রেকর্ড যাচাই করতে মোবাইল বায়োমেট্রিক সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রাথমিক স্ক্রিনিংয়ে কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ রেকর্ড পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।
পূর্ববর্তী উদ্ধার অভিযান ও ভারতের সতর্কতা
এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। চলতি বছরের মার্চে মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সীমান্তে পরিচালিত অভিযানে ভারতীয় বিমানবাহিনীর দুটি বিমানে ৫৪৯ জন ভারতীয় নাগরিককে দেশে ফেরানো হয়েছিল। এদের অনেকে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা ছিলেন। তাদেরও আইটি খাতে চাকরির মিথ্যা প্রলোভনে মিয়ানমারে পাচার করা হয়েছিল, যেখানে চীনা অপরাধচক্র এসব কেন্দ্র পরিচালনা করত।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বারবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চাকরির প্রলোভনে ছদ্মবেশী প্রতারণার বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে।
অভিযান ও আন্তর্জাতিক চাপ
গত সোমবার মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কেকে পার্কে অভিযানের ঘোষণা দেয়। এই অভিযানের সময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে—এক প্রত্যক্ষদর্শী থাই নারী বলেন, “আমি ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাৎ দরজায় জোরে ধাক্কা ও চীনা ভাষায় চিৎকার শুনি। তাদের হাতে বন্দুক ছিল।”
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, লোকজন ফোমের বাক্স ব্যবহার করে মোয়ে নদী পেরিয়ে থাইল্যান্ডে প্রবেশ করছে, যেখানে থাই নিরাপত্তা বাহিনী তাদের লাগেজ ও কাগজপত্র পরীক্ষা করে।
সাইবার নেটওয়ার্ক ও স্টারলিংক সংযোগ বন্ধ
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রতারণা কেন্দ্রগুলোতে স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছিল, যা স্থানীয় অবকাঠামো ছাড়াই নেটওয়ার্ক চালানোর সুযোগ দেয়। গত সপ্তাহে এএফপি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, মিয়ানমারের এসব সেন্টারে স্টারলিংকের হাজারো টার্মিনাল ব্যবহার হচ্ছিল।
![]()
ইলন মাস্কের স্পেসএক্স বুধবার জানায়, তারা ইতিমধ্যে মিয়ানমারের প্রতারণা কেন্দ্রে ব্যবহৃত ২,৫০০টিরও বেশি ডিভাইস বন্ধ করে দিয়েছে। কেকে পার্কে অভিযানকালে সেনারা কিছু স্টারলিংক টার্মিনাল জব্দ করেছে বলে রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে।
সামরিক জান্তার দ্বৈত ভূমিকা
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই এসব প্রতারণা কেন্দ্রের ব্যাপারে চোখ বুজে থেকেছে, কারণ এগুলো থেকে তাদের মিত্র মিলিশিয়ারা বিপুল অর্থ আয় করে—যা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেনাদের লড়াইয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
চীনের চাপও এখন বাড়ছে, কারণ এই প্রতারণায় অনেক চীনা নাগরিক জড়িত ও প্রতারিত হচ্ছে। ফলে বেইজিং মিয়ানমারের ওপর কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
মিয়ানমারের কেকে পার্কে অভিযান শুধু মানব পাচার নয়, আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধের বিস্তার ও সীমান্তভিত্তিক মানবিক সংকটের ভয়াবহ চিত্র উন্মোচন করেছে। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ এখন তাদের নাগরিকদের সুরক্ষায় কূটনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছে, তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতারণার এই চক্র ভাঙতে হলে শুধু অভিযান নয়, বরং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাই হতে পারে একমাত্র সমাধান।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















