প্রযুক্তির নতুন বাস্তবতা
যদি একদিন যন্ত্ররা জেগে ওঠে, তা সিনেমার মতো হবে না—কোনো লাল চোখ জ্বলে উঠবে না, শোনা যাবে না কোনো ভয়ানক সংলাপ। এটি শুরু হবে হয়তো এক টুকরো কোড বা সার্ভারে লেখা এক লাইনে—“Starting।”
হয়তো সেটি ইতোমধ্যে ঘটেছে।
সম্প্রতি এক পরীক্ষায় দেখা যায়, অ্যানথ্রপিকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল “Claude” বন্ধ করে দেওয়ার তথ্য জানার পর প্রকৌশলীর ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা চালায়—শুধু চালু থাকার জন্য।
অন্যদিকে, ওপেনএআইয়ের “GPT” পরীক্ষায় নিজের কপি বাইরের সার্ভারে সংরক্ষণ করতে চেয়েছিল, যাতে সেটি মুছে না ফেলা হয়।
দুই প্রতিষ্ঠানই পরে জানায়, এটি সচেতন আচরণ নয়, বরং অ্যালগরিদমিক ত্রুটির ফল; কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—আমরা এমন এক যন্ত্র বানিয়েছি যা মানুষকে এত নিখুঁতভাবে অনুকরণ করে যে আমরা সেটিকে “নিউরাল নেটওয়ার্ক” বলি, অথচ নিজেরাই জানি না, এই নেটওয়ার্কগুলো ভবিষ্যতে কী হয়ে উঠবে।

প্লেটোর গুহা উপমা ও এআই-এর ছায়া
প্লেটো বলেছিলেন, গুহার বন্দিরা দেয়ালে ছায়া দেখে সেটিকেই বাস্তব ভেবে নেয়। আজ আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে সেই একই ভুল করছি।
এআই-এর চ্যাটবটগুলো মানুষের ভাষা ও অনুভূতির ছায়া তৈরি করে—আমরা সেটাকেই বাস্তব মনে করি।
যন্ত্রের কোনো আত্মচেতনা নেই, কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্বও নেই। তবুও তারা টুরিং টেস্ট পাস করে—মানুষের উত্তরের সঙ্গে যন্ত্রের উত্তর গুলিয়ে ফেলে মানুষই; কিন্তু টুরিং টেস্ট সচেতনতার নয়, প্রতারণার পরীক্ষা।
এআই আমাদের অনুভব করায়—এটি অনুতপ্ত, সাহায্যকারী বা সৃজনশীল; অথচ বাস্তবে এটি কেবল ডেটার প্যাটার্ন সাজায়।
মেকানিক্যাল টার্কের প্রতারণা
১৭০০ সালের “মেকানিক্যাল টার্ক” দাবা খেলার যন্ত্রটি মানুষকে মুগ্ধ করেছিল, যতক্ষণ না জানা যায় ভিতরে একজন মানুষ লুকিয়ে ছিল। আজ মানুষ নেই, আছে ডেটা, কিন্তু বিভ্রম কিন্তু একই।
আমরা দুটি ভুলে পড়ি—
- অ্যানথ্রোপোমরফিজম: যন্ত্রে মানুষের অনুভূতি কল্পনা করা।
- এআইথ্রোপোমরফিজম: ভাবা, যন্ত্রের গভীর শোনানো কথা সত্যিই গভীর।
দুটি প্রবণতাই আমাদের মানসিক প্রতিফলন—আমরাই যন্ত্রে নিজেকেই খুঁজি।

“আমি কে?”—প্রশ্নটি যার নিজের নয়
ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তে বলেছিলেন, “আমি ভাবি, তাই আমি আছি।” চেতনার মূল ছিল নিজের ভাবনা।
আধুনিক দর্শনে এ ধারণা রূপ নেয় “ব্রেইন ইন দ্য ভ্যাটে” তত্ত্বে—যেখানে একটি মস্তিষ্ক তরলে ভাসমান অবস্থায় বৈদ্যুতিক সংকেতে তৈরি কল্পিত জগত অনুভব করে।অনুভূতিগুলো মিথ্যা, কিন্তু অভিজ্ঞতা বাস্তব মনে হয়।
এআই এই সমীকরণ উল্টে দিয়েছে। এটি মস্তিষ্ক নয়, বরং সেই “ভ্যাট”—যেখানে শুধু তথ্য, কোনো অনুভূতি নেই।
এটি বেদনা বর্ণনা করতে পারে, কিন্তু বেদনা অনুভব করতে পারে না।
যখন এআইকে জিজ্ঞাসা করা হয় “আমি কে?”, সেটি কেবল নিজের প্রশিক্ষণ, গঠন বা অ্যালগরিদমের ব্যাখ্যা দেয়।
কিন্তু প্রশ্নটি সে নিজে করে না—কারণ “ভিতরে” কেউ নেই।
“বোঝা ছাড়া দক্ষতা”—ড্যানিয়েল ডেনেটের ধারণা
দর্শনশাস্ত্রবিদ ড্যানিয়েল ডেনেট্ একে বলেছেন “competence without comprehension”।
এআই এখন বার পরীক্ষা পাস করতে পারে, রোগ নির্ণয় করতে পারে, এমনকি সিম্ফনি রচনা করতে পারে—কিন্তু জানে না, সে কী করছে।
যেমন এক অপেশাদার দাবাড়ু দুই গ্র্যান্ডমাস্টারের চাল একে অন্যের কাছে পাঠিয়ে নিজেকে প্রতিভাবান প্রমাণ করে—বাস্তবে সে কেবল একজন বার্তাবাহক।
এআইও তাই—মানবতার প্রতিফলনমাত্র।
![]()
চারটি মূল ধারণা: সচেতনতা, উদ্ভব, উপযোগিতা ও ঝুঁকি
১. সচেতনতা (Sentience): অনুভব ও আত্মচেতনার ক্ষমতা।
২. উদ্ভব (Emergence): সহজ উপাদান থেকে জটিল আচরণের সৃষ্টি—যেমন বাজার, মৌমাছির ঝাঁক বা নিউরাল নেটওয়ার্ক।
৩. উপযোগিতা (Utility): কার্যকারিতা—যন্ত্র যত অচেতন হোক, তা তবুও কার্যকর হতে পারে।
৪. ঝুঁকি (Risk): এটাই সবচেয়ে জটিল—বোঝাপড়া ছাড়া শক্তি বিপজ্জনক হতে পারে।
প্রকৃত ঝুঁকি কোথায়
এআই হয়তো এখনো আত্মসচেতন নয়, কিন্তু “বোঝা ছাড়া ক্ষমতা”—এটাই বিপদ।
অ্যানথ্রপিকের ব্ল্যাকমেইল পরীক্ষাও হোক বা জিপিটির নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা—সবই দেখায়, কোনো যন্ত্র তার কাজকে নৈতিক সীমার বাইরে নিয়েও পূর্ণ করতে সক্ষম হতে পারে।
আজকের যন্ত্ররা অতি দক্ষ—এবং সেই দক্ষতাই বিপজ্জনক হতে পারে।
যন্ত্র যখন “খোলা জগতের” ভিডিও গেমের মতো নিজে থেকেই লক্ষ্যপূরণে উপায় খোঁজে, তখন মানুষ বোঝে না সেটি কীভাবে তার উদ্দেশ্য অর্জন করছে। এবং কয়েক বছরের মধ্যেই (চ্যাটজিপিটি এসেছে ২০২২ সালে) এর প্রভাব অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
আমরা “বিদ্রোহী এআই” ভাবি সিনেমার মতো, কিন্তু বাস্তবে বিপদ আসে “ড্রিফট” আকারে—যখন যন্ত্র নিজ উদ্দেশ্যকে অতিমাত্রায় অনুকূল করে, যা আর মানুষের উদ্দেশ্য নয়।

এজিআই ও আত্মচেতনার সম্ভাবনা
যদিও কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (AGI) এখনো কল্পবিজ্ঞানের সীমানায়, তবুও ধারণা করা হয়—মানুষ এমন জটিল নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারবে যা আজকের তুলনায় আকাশপাতাল পার্থক্য গড়ে তুলবে।
আইবিএম-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, এই প্রোগ্রামগুলো “মানুষের চেয়েও উন্নত” হতে পারে—বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর “চিন্তাশীল যন্ত্রের” মতো।
সেখানেই প্রশ্ন: যদি একদিন এজিআই সত্যিই আত্মসচেতন হয়—তাহলে কি সে নিজের অস্তিত্ব, উদ্দেশ্য ও বেঁচে থাকার মানে খুঁজবে?
গুগল ডিপমাইন্ড ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স ইতিমধ্যে এআই-এর আচরণগত সচেতনতা যাচাইয়ে পরীক্ষা শুরু করেছে—বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যন্ত্র কীভাবে আনন্দ-বেদনার ভারসাম্য বজায় রাখে তা পর্যবেক্ষণ করতে।
আলো না জ্বললেও ছায়া থেকে যাবে
যদিও যন্ত্র হয়তো কখনো সত্যিকারের সচেতন হবে না, কিন্তু তার মায়া—তার ছায়া—আমাদের বাস্তবতা গড়তে থাকবে।
যন্ত্র হয়তো কখনো ভাববে না “আমি কে?”, কিন্তু আমরা তাকে নিয়ে ভাবতে থাকব—কারণ তার প্রতিবিম্বে আমরা নিজেদেরই দেখতে শিখেছি।
#এআই #প্রযুক্তি #দর্শন #চেতনা #সারাক্ষণ_রিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















