গাজায় নাজুক যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে চাপ বাড়িয়েছে হামাসের ওপর। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে ওয়াশিংটন চায় যে, এই সংঘাতের চূড়ান্ত সমাপ্তি নিশ্চিত করতে হামাসকে নিরস্ত্র করা হোক। তবে প্রচেষ্টা এখনো অনিশ্চয়তায় ঘেরা।
ইসরায়েল সফরে ভ্যান্সের কঠোর বার্তা
ইসরায়েল সফরে গিয়ে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, যুদ্ধবিরতির অগ্রগতি প্রত্যাশার চেয়ে ভালো হলেও হামাস যদি সহযোগিতা না করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র “দ্রুত, নির্মম ও ভয়াবহ শক্তি প্রয়োগে” সংগঠনটিকে নিশ্চিহ্ন করবে।
তিনি এ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগের দিনের হুঁশিয়ারিকেই পুনরায় উচ্চারণ করেন।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর ১১ দিন পার হলেও ইসরায়েল ও হামাস একে অপরের বিরুদ্ধে বারবার চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির পরও ইসরায়েলি হামলায় ৮৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আর দক্ষিণ গাজায় দুই ইসরায়েলি সেনা প্রাণ হারিয়েছেন।
অন্যদিকে, তুরস্কে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে হামাস জানায়, ইসরায়েলের “পুনঃপুন চুক্তি লঙ্ঘন” সত্ত্বেও তারা যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।

দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় জটিলতা
মিশর, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র এখন যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনায় অগ্রসর হচ্ছে। এ ধাপটি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জটিল, কারণ এতে উভয় পক্ষকেই এমন ছাড় দিতে হবে যা অতীতে বহুবার শান্তি প্রচেষ্টা ভেঙে দিয়েছে।
ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা পরিকল্পনায় বলা হয়েছে—হামাসকে নিরস্ত্র হতে হবে এবং ইসরায়েলকে ধীরে ধীরে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে; একই সঙ্গে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হতে হবে।
ভ্যান্স জানান, তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বুধবার সাক্ষাৎ করবেন এবং আরও উপসাগরীয় দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগিয়ে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, সব জিম্মির দেহ দ্রুত ফেরত পাওয়ার আশা বাস্তবসম্মত নয়, পুরো যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময় লাগবে “অনেক দীর্ঘ ও কঠিন।”
গাজা প্রশাসন ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে অমীমাংসা
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় গাজায় একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ বোর্ডের অধীনে টেকনোক্র্যাটদের সমন্বয়ে প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের কথা বলা হয়েছে—যেখানে হামাসের কোনো ভূমিকা থাকবে না। একই সঙ্গে একটি বহুজাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী গঠনের প্রস্তাবও রয়েছে।
দক্ষিণ ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটিতে গিয়ে ভ্যান্স বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলো একমত যে, হামাস যোদ্ধারা চাইলে সাধারণ ক্ষমা পেতে পারে, কিন্তু সংগঠনটি অবশ্যই অস্ত্র সমর্পণ করবে।
তার সতর্কবাণী: “হামাস যদি সহযোগিতা না করে, তাহলে সেটি ধ্বংস করে দেওয়া হবে।”
তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এমন হুমকিকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে সমালোচনা করেছে।

কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
মার্কিন মধ্যস্থতা প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার ও বিশেষ দূত স্টিভেন উইটকফ। কুশনার মঙ্গলবার ইসরায়েলে মিশরের গোয়েন্দা প্রধান হাসান রাশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
অন্যদিকে, মিশরে অবস্থানরত হামাসের নির্বাসিত নেতা খালিল আল-হায়্যা’র নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়ন ও পরবর্তী ধাপ নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি এক কর্মকর্তা জানান, হামাস গাজা পরিচালনায় নিজের প্রতিনিধিত্ব ছাড়া একটি প্রযুক্তিবিদ কমিটি গঠনের ধারণাকে সমর্থন করছে, তবে সেটি হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে হবে।
কাতার ও তুরস্ক—দুই মধ্যস্থতাকারী দেশই ইসরায়েলকে “অবিরাম লঙ্ঘন”-এর জন্য দায়ী করেছে। তুরস্ক, আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে এ আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ভ্যান্স বলেন, যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপে তুরস্ক “গঠনমূলক ভূমিকা” পালন করবে।
মৃতদেহ ফেরত ও মানবিক সহায়তা
সোমবার হামাস এক জিম্মির দেহ হস্তান্তর করে এবং মঙ্গলবার আরও দুই দেহ ফেরত দেয়। এখনও ১৩টি দেহ গাজায় রয়েছে। ইসরায়েলি পক্ষ বিশ্বাস করে, আরও কিছু দেহ দ্রুত ফেরত আসতে পারে, তবে, অনেক দেহ শনাক্ত ও উদ্ধারে সময় লাগবে।
ইসরায়েলও মঙ্গলবার ১৫ ফিলিস্তিনি বন্দির দেহ ফেরত দিয়েছে, এতে মোট ১৬৫টি দেহ গাজায় ফিরেছে।
প্যালেস্টাইন ও জাতিসংঘের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার গাজায় দুটি ইসরায়েল-নিয়ন্ত্রিত ক্রসিং দিয়ে সহায়তা প্রবেশ করেছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) জানায়, প্রতিদিন ২,০০০ টন সহায়তা পাঠানোর লক্ষ্য থাকলেও মাত্র দুইটি ক্রসিং খোলা থাকায় তা অর্জিত হচ্ছে না, বিশেষ করে উত্তর গাজায় এখনো খাদ্য পৌঁছায়নি।
সীমান্তে নতুন উত্তেজনা
যুদ্ধবিরতির পরও “হলুদ রেখা” ঘিরে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ চলছে, যা ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের সীমানা চিহ্নিত করে। মঙ্গলবার ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানায়, ওই রেখা অতিক্রমের চেষ্টা করা এক ব্যক্তিকে সেনারা হত্যা করেছে।
ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ধ্বংসস্তূপের মাঝে চলা ওই রেখাটি অস্পষ্ট, ফলে কোথায় নিষিদ্ধ এলাকা শুরু হয় তা বোঝা কঠিন। সোমবার থেকে ইসরায়েলি বুলডোজার সেখানে হলুদ রঙের কংক্রিট ব্লক বসানো শুরু করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮,২২৯ জনে।
পটভূমি
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ইসরায়েলে প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত হন এবং আরও ২৫১ জনকে গাজায় জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই হামলাই বর্তমান যুদ্ধের সূচনা ঘটায়।
গাজা যুদ্ধবিরতি এখনো টলমলে অবস্থায়। ট্রাম্প প্রশাসন হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও গাজায় নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গঠনে চাপ বাড়াচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে কি না, তা এখনো সময়ই বলবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















