প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের এক যুগান্তকারী প্রকল্প
১৯৮৯ সালে উদ্বোধনের সময় টরন্টোর স্কাইডোম (বর্তমান রজার্স সেন্টার) ছিল বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ স্বয়ংক্রিয়ভাবে খোলা-বন্ধ হওয়া ছাদবিশিষ্ট স্টেডিয়াম। এলিসডন নামের একটি মধ্যম আকারের নির্মাণ সংস্থা এই প্রকল্পে প্রায় সব সম্পদ বিনিয়োগ করেছিল। এটি শুধু একটি ক্রীড়া স্থাপনা নয়, বরং কানাডার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও যৌথ প্রচেষ্টার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
ইঞ্জিনিয়াররা তখন যমজ বায়ু সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে ছাদ খোলা, বন্ধ ও অর্ধ-খোলা অবস্থায় বাতাস ও তুষারের চাপ পরীক্ষা করেন। বালুকণার মাধ্যমে তুষারপাতের আচরণ অনুকরণ করা হয়, যা ছিল সেই সময়ের জন্য বিপ্লবী এক পরীক্ষা।
বৃষ্টির রাত থেকে স্টেডিয়ামের ধারণা
এই অনন্য স্টেডিয়ামের গল্প শুরু হয় ১৯৮২ সালের “রেইন বোল” নামের এক দুঃসহ ফুটবল ম্যাচ থেকে। টরন্টো আর্গোনটস দলের সমর্থকেরা Exhibition Stadium-এ বৃষ্টিতে ভিজে খেলা দেখার অভিজ্ঞতায় ক্ষুব্ধ হয়ে ডোমযুক্ত একটি স্টেডিয়ামের দাবি জানান। বৃষ্টির সেই রাতে জমে ওঠা ক্ষোভ থেকেই জন্ম নেয় স্কাইডোম নির্মাণের ধারণা।
তৎকালীন মেয়র আর্ট এগলেটন স্বীকার করেন, “আমাদের আবহাওয়া বিবেচনায় ছাদবিহীন স্টেডিয়াম কখনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না।” তাঁর নেতৃত্বেই শহরের কেন্দ্রস্থলে নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
জায়গা সংকট ও পরিকল্পনার চ্যালেঞ্জ
স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য ইউনিয়ন স্টেশনের পশ্চিমে রেলওয়ে জমি বেছে নেয়া হয়। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের আপত্তি, মাটি দূষণ এবং ট্রাফিকের অজুহাতে কাজ বারবার আটকে যায়। শেষ পর্যন্ত অন্টারিও প্রিমিয়ার বিল ডেভিসের হস্তক্ষেপে জমির ব্যবস্থা হয়।
১৯৮৫ সালে প্রাদেশিক সরকার ‘স্টেডিয়াম কর্পোরেশন অব অন্টারিও’ গঠন করে এবং একটি আন্তর্জাতিক নকশা প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। এই প্রতিযোগিতায় টরন্টোর স্থপতি রড রবি ও অটোয়ার প্রকৌশলী মাইকেল অ্যালেনের দল জিতে নেয় মূল দায়িত্ব। তাঁদের উদ্ভাবনী নকশায় তিনটি বিশাল স্টিল প্যানেল বৃত্তাকার রেলে ঘুরে ছাদ খোলা ও বন্ধ করত।
প্রকৌশলীদের সৃজনশীল লড়াই
রবি ও অ্যালেন একে অপরের কাছে ডিজাইন পাঠাতেন গ্রেহাউন্ড বাসে করে—তৎকালীন সময়ের এক অভিনব উপায়। অ্যালেন এক ফ্লাইটে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ অনুপ্রেরণা পান—কীভাবে এত ছোট জায়গায় চলমান ছাদ বসানো সম্ভব। সপ্তাহান্তে তিনি নকশা যাচাই করতে থাকেন, এবং শেষে বুঝতে পারেন—“এটা কাজ করতে পারে।” এরপরই শুরু হয় এক সাহসী প্রকল্পের বাস্তবায়ন।
তাদের নকশা ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে—একটি বিশাল ছাদ যা গোলাকার ও অনুভূমিক দুই রেলপথে চলবে, তুষার ও বাতাসের চাপ সামলাবে, এবং কানাডার কঠোর শীতেও টিকবে।
বাতাস ও তুষারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
গুয়েলফভিত্তিক আরডব্লিউডিআই নামের এক ছোট প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান পায় বাতাস ও তুষারের প্রভাব যাচাইয়ের দায়িত্ব। তাদের পরীক্ষায় দেখা যায়, কিছু ক্ষেত্রে ছাদের ওপরের বাতাসের চাপ বোয়িং ৭৪৭ বিমানের উড্ডয়নের সমান। সংস্থাটি তিন দশকের আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে নতুন সফটওয়্যার তৈরি করে, যা তুষার জমার ভার ঘন্টা ধরে হিসাব করত। ১১ হাজার টন ইস্পাতে তৈরি সেই ছাদ প্রতিটি কিলোগ্রাম কোথায় বসবে তা হিসাব করতে হয়েছিল নিখুঁতভাবে।
নির্মাণে এলিসডনের সাহসী বাজি
এলিসডনের প্রধান ডন স্মিথের কাছে এটি ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। কোম্পানির অধিকাংশ সম্পদ এই এক প্রকল্পে ঢেলে দেয় তারা। শত শত কর্মী দিন-রাত কাজ করে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যান। কোম্পানির নীতি ছিল—“যেহেতু আমরা এমন কিছু করছি যা আগে কখনো হয়নি, সেহেতু প্রচলিত নিয়মে নয়, নতুনভাবে করব।”
তাদের এই অধ্যবসায়েই মাত্র ৩০ মাসে নির্মিত হয় বিশাল এই স্থাপনা—যা আজকের দিনে অসম্ভব বলেই মনে হয়।
উদ্বোধনের রাত: ‘ভেতরে বৃষ্টি’
১৯৮৯ সালের জুনে জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনের রাতে ছাদ খোলা হলো আকাশের দিকে—আর ঠিক তখনই শুরু হলো বৃষ্টি! তৎকালীন প্রিমিয়ার ডেভিড পিটারসন, পল গডফ্রে এবং মেয়র এগলেটন সবাই ভিজে যান, তবে মুহূর্তটি ছিল ঐতিহাসিক। দুই দিন পর ব্লু জেস দলের প্রথম খেলা হেরে গেলেও, স্টেডিয়ামটি হয়ে উঠল জাতীয় গর্বের প্রতীক।
উত্তরাধিকার ও পুনর্জাগরণ
সাফল্যের পরও প্রকল্পটি আর্থিকভাবে কঠিন সময়ের মুখে পড়ে। ১৯৯৩ সালের মধ্যে সরকারি কর্পোরেশনটির ঋণ দাঁড়ায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ১৯৯৮ সালে এটি দেউলিয়া ঘোষণা করে বেসরকারি হাতে বিক্রি হয়, এবং পরবর্তীতে রজার্স কোম্পানি ২৫ মিলিয়ন ডলারে এটি কিনে নাম দেয় ‘রজার্স সেন্টার’।
এলিসডন পরবর্তীতে কানাডার অন্যতম বৃহৎ নির্মাণ কোম্পানিতে পরিণত হয়। আরডব্লিউডিআই-ও বিশ্বজুড়ে ১,০০০ প্রকৌশলীর প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়, যাদের কাজের মধ্যে রয়েছে বুর্জ খলিফা, লন্ডন মিলেনিয়াম ব্রিজ ও গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন স্কাইওয়াক।
আজ রজার্স সেন্টার নতুন রূপে আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে—উচ্চ তলার প্যাটিও, দর্শনীয় এলাকা ও আধুনিক সংস্কারে এটি টরন্টোর স্থাপত্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
বৃষ্টির রাতে জন্ম নেয়া এই স্থাপত্য আজও প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। মেয়র এগলেটন এখনো তাঁর অফিসে সেই উদ্বোধনী দিনের কোদালটি রেখে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “নতুন স্টেডিয়ামগুলো হয়তো দ্রুত খোলে, কিন্তু স্কাইডোম—আমার দৃষ্টিতে—এখনো এক অনন্য স্থাপত্যকীর্তি।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















