মানসিক অন্ধকারে আলো হয়ে ওঠা বন্ধুত্ব
মেলিসা লুডউইগ জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময় পার করার কথা ছিল—সদ্য বিবাহ, এক আদুরে কন্যাশিশুর মা, আর মাতৃত্বকালীন ছুটিতে সময়ের অভাব নেই। কিন্তু শিশুর ঘরে দোলনায় বসে থাকা সেই সময়গুলোতে তিনি বুঝলেন, তাঁর মনে জমছে বিষণ্নতার ছায়া। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন, কিছু একটা বদলানো দরকার। মনে হলো, “এই ঘর থেকে বেরোতে হবে, কিছু নারী বন্ধুর প্রয়োজন।”
এই সিদ্ধান্তই হয়ে উঠল তাঁর জীবনের নতুন মোড়—একটি “গোষ্ঠী” খুঁজে পাওয়া, যাদের সঙ্গে তিনি ভাগ করে নিতে পারেন নিজের অনুভূতি, ভয়, ও ভালোবাসা।
‘টেন্ড অ্যান্ড বিফ্রেন্ড’—নারীর প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া
মানুষের চাপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমরা প্রায়ই “ফাইট অর ফ্লাইট”—অর্থাৎ লড়াই বা পালিয়ে যাওয়া—ধারণাটি জানি। কিন্তু পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লরা কাউসিনো ক্লেইন মনে করেন, নারীর শরীর ও মন ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। তাঁর মতে, নারীরা “টেন্ড অ্যান্ড বিফ্রেন্ড” অর্থাৎ “যত্ন ও বন্ধুত্বের” পথে হাঁটে—যা সন্তানকে রক্ষা করে, সামাজিক নিরাপত্তা তৈরি করে এবং মানসিক প্রশান্তি আনে।

এই তত্ত্বটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে Psychological Review জার্নালে, যা দেখায়—বিবর্তনের ধারায় নারীরা একে অপরের সঙ্গে বন্ধন গড়ে তোলার মাধ্যমে টিকে থাকার উপায় খুঁজে নিয়েছে।
ইতিহাসের শিকড়: নারী ও সামাজিক সহাবস্থান
প্রাচীন সমাজে নারীই ছিলেন শিশুপালনের প্রধান দায়িত্বে। আগুন লাগলে বা বিপদে পড়লে “ফাইট অর ফ্লাইট” তেমন কার্যকর ছিল না। বরং আশেপাশের নারীদের সঙ্গে সহায়তার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা—অর্থাৎ “বিফ্রেন্ড”—ছিল বেঁচে থাকার কৌশল।
যদি কোনো হুমকি আসত, তখন শরীর থেকে নিঃসৃত হতো প্রশমক হরমোন—অক্সিটোসিন ও প্রাকৃতিক ওপিওইড। ফলে নারীরা সন্তানকে বুকে টেনে নিয়ে শান্ত রাখতেন, অর্থাৎ “টেন্ড” করতেন, এবং অনেক সময় সেই হুমকি নিঃশব্দে কেটে যেত। এই প্রবৃত্তিই পরবর্তী প্রজন্মের টিকে থাকা নিশ্চিত করেছে—এভাবেই বিবর্তনের গল্প গড়ে উঠেছে।
আধুনিক সমাজেও সেই প্রবৃত্তি
আজকের আমেরিকান নারী হয়তো বন্যপ্রাণীর হামলার মুখে পড়েন না, কিন্তু মানসিক চাপ, সামাজিক প্রত্যাশা ও একাকীত্বের বিরুদ্ধে তাঁরা লড়েন সেই পুরনো প্রবৃত্তি দিয়েই—সহযোগিতার মাধ্যমে। সন্তান জন্মের পর লুডউইগের বন্ধুত্ব খোঁজার আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রকৃতিরই ইঙ্গিত। কিছু গবেষক বলেন, প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা অনেক সময় এমন সামাজিক বন্ধন পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেয়, যাতে আশপাশের মানুষ একত্র হয়ে মাকে সহায়তা করে।

বন্ধুত্ব—নারীর প্রাথমিক সম্পর্ক
এই প্রেক্ষাপটে, এইচবিও (HBO) সিরিজ Sex and the City-এর শার্লট চরিত্রটি এক প্রশ্ন তুলেছিল—“এই বন্ধুত্বগুলোই কি আমাদের জীবনের প্রধান সম্পর্ক নয়?”
মনোবিজ্ঞানী মারিসা বারাশ মন্তব্য করেন, “নারীরা একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হলে, জীবনের নানা দিক নিয়ে এক ধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি হয়। এতে মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে।”
একে অপরের জন্য জায়গা তৈরি করা
লুডউইগ এক ‘ওয়েলনেস গ্রুপ’-এর মাধ্যমে খুঁজে পান তাঁর নিজের গোষ্ঠী। সেখানে কাউকেই ব্যাখ্যা দিতে হয়নি—সবাই এসেছিল একই মানসিক প্রয়োজনে, সংযোগের জন্য।
তিনি বলেন, “নারীরা চায় তাদের দেখা হোক, শোনা হোক, বোঝা হোক এবং ক্ষমতায়িত করা হোক। আমার বান্ধবীদের সঙ্গে আমরা একে অপরের জন্য এমন একটি জায়গা তৈরি করি, যেখানে অনুভূতিগুলো বড় হতে পারে, বোঝা যায় এবং শেষে মুক্তি মেলে।”
নারী বন্ধুত্ব কেবল আবেগ নয়, এটি মানব বিবর্তনের একটি ধারাবাহিকতা। এটি শেখায়—একসঙ্গে থাকা, সহানুভূতি প্রকাশ করা এবং একে অপরকে বোঝাই টিকে থাকার প্রকৃত শক্তি।
#নারীবন্ধুত্ব #মানসিকস্বাস্থ্য #বিবর্তন #সামাজিকসম্পর্ক #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















