হানহওয়া জাহাজঘাটায় প্রধানমন্ত্রীর সফর
দক্ষিণ কোরিয়ার জিওজেতে অবস্থিত হানহওয়া ওশেনের বিশাল জাহাজ নির্মাণ ঘাটিতে ৩০ হাজারের বেশি কর্মী এখানে কাজ করেন। পাঁচ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই স্থাপনাটি আগামী সপ্তাহে কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নিকে স্বাগত জানাতে যাচ্ছে, যিনি নতুন সাবমেরিন কেনার লক্ষ্যে সেখানে পরিদর্শনে যাচ্ছেন।
এই ঘাটিতে চারটি বিশালাকায় ক্রেন, সমাবেশ হল এবং বহুতল ভবনের সমান বড় জাহাজের অংশ নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া এখন কানাডার ১২টি সাবমেরিন সরবরাহের প্রতিযোগিতায় দুটি চূড়ান্ত প্রার্থীর মধ্যে একটি, অন্যটি জার্মানি ও নরওয়ের যৌথ প্রস্তাব।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা উচ্চাকাঙ্ক্ষা
সিউল এখন বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের শীর্ষ ১০ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে স্থান পেয়েছে।

হানহওয়ার প্রস্তাব হলো ডিজেল-ইলেকট্রিক KSS-III Batch-II সাবমেরিন, কারণ কানাডা পারমাণবিক চালিত সাবমেরিন কেনা থেকে বিরত রয়েছে। এই চুক্তি দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য এক ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের সুযোগ—যদি এটি জিতে যায়, তবে সিউল বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা বাজারে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।
কানাডার কৌশলগত দ্বিধা
কার্নির এশিয়া সফরের মূল লক্ষ্য কেবল প্রতিরক্ষা নয়, বরং অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য সুরক্ষা নীতি ও শুল্কযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কানাডা এখন ইউরোপ ও এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গভীর করতে চাইছে।
তিনি আগামী সপ্তাহে কুয়ালালামপুরে আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দেবেন, পরিদর্শন করবেন সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার গেয়ংজুতে এপেক ফোরাম—যেখানে সম্ভবত তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন।
প্রতিরক্ষা ব্যয়ের নতুন অধ্যায়
কানাডা আগামী এক দশকে প্রতিরক্ষায় কয়েক দশক পর সবচেয়ে বড় ব্যয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ১২টি সাবমেরিন কেনা তারই অংশ। এই প্রকল্পের ব্যয় ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হবে এবং এর মেয়াদ চলবে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়।
যদি চুক্তি হানহওয়ার হাতে যায়, তবে এটি হবে কানাডার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো অ-পশ্চিমা দেশের কাছ থেকে বড় অস্ত্র প্ল্যাটফর্ম কেনা।
দক্ষিণ কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রভাব
জার্মানি ও নরওয়ে ন্যাটোর অংশ হলেও দক্ষিণ কোরিয়া নয়। তবুও ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যেই সিউল নতুন ক্রেতা পাচ্ছে — যেমন পোল্যান্ড, যেটি ইতিমধ্যে কোরিয়ার কাছ থেকে শত শত ট্যাংক, বিমান, হাউইটজার ও রকেট লঞ্চার কিনেছে।
এখন কানাডা যদি কোরিয়ার প্রস্তাব নেয়, তবে এটি শুধু প্রতিরক্ষা সহযোগিতাই নয়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কানাডার ভূমিকায়ও বড় পরিবর্তন আনবে।
কানাডার নৌবাহিনীর নতুন যুগ
এই সাবমেরিন ক্রয় কানাডার নৌবাহিনীর জন্য এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনবে। ১৯৬০-এর দশকের পর দেশটি আর নতুন সাবমেরিন কেনেনি, বর্তমানে ব্যবহৃত চারটি পুরনো সাবমেরিনের মধ্যে কেবল একটি সচল।

ভাইস-অ্যাডমিরাল অ্যাঙ্গাস টপশি বলেন, “আমরা কখনও প্রকৃত সাবমেরিন যুদ্ধের জন্য সাবমেরিন কিনিনি; শুধু অনুশীলনের জন্যই ব্যবহার করেছি।” কিন্তু এখন সময় বদলেছে — রাশিয়া ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীর বাড়তি তৎপরতায় সাবমেরিন এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ অস্ত্র।
সাবমেরিনের কৌশলগত গুরুত্ব
নতুন সাবমেরিনগুলো কেবল প্রতিরক্ষার জন্য নয়, বরং আক্রমণাত্মক সক্ষমতাও রাখবে। দক্ষিণ কোরিয়ার KSS-III মডেল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে সক্ষম।
টপশি বলেন, “একটি সাবমেরিন এমন এক অস্ত্র যা শত্রুর চোখে না পড়েও নজরদারি ও আঘাত হানার ক্ষমতা রাখে। এটি ‘অদৃশ্য প্রতিরোধ’-এর প্রতীক।”
প্রস্তাব ও বিনিয়োগে প্রতিযোগিতা
হানহওয়া ও জার্মান টিকেএমএস উভয়েই তাদের প্রস্তাবকে আরও আকর্ষণীয় করতে কানাডায় কর্মসংস্থান, স্থানীয় উৎপাদন ও সরবরাহ চুক্তির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
হানহওয়া জানিয়েছে, ২০২৬ সালে চুক্তি স্বাক্ষর হলে ২০৩২ সালের মধ্যে প্রথম সাবমেরিন এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে চারটি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের প্রতিশ্রুতি
দক্ষিণ কোরিয়ার হানহওয়া কানাডার স্টিল কোম্পানি অ্যালগোমা স্টিল থেকে ইস্পাত কেনা, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানি ও কানাডার টেলিস্যাট এবং এমডিএর সঙ্গে মহাকাশ প্রযুক্তিতে অংশীদার হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
হানহওয়ার কর্মকর্তারা বলেন, “ইউরোপীয় দেশগুলো একদিন রাশিয়ার হুমকি কমলে সামরিক ব্যয় হ্রাস করবে, কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া কখনও তা করতে পারবে না — কারণ উত্তর কোরিয়া ও আঞ্চলিক উত্তেজনা সবসময় থাকবে।”
সাবমেরিন নির্মাণ ও নিরাপত্তা প্রেক্ষাপট
হানহওয়ার কারখানাটি দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে — উত্তর কোরিয়ার হুমকি থেকে সবচেয়ে দূরে। কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেন, KSS সাবমেরিন এমনভাবে তৈরি যে ছোট দেশও এটি দিয়ে বড় প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে পারে।
কানাডার জন্য বৈশ্বিক বার্তা
ম্যাকডোনাল্ড-লরিয়ের ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক জনাথন মিলার বলেন, “যদি কানাডা কোরিয়াকে বেছে নেয়, তবে এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কানাডার অঙ্গীকারকে আরও দৃঢ় করবে এবং ইউরোপনির্ভরতা কমাবে।”

কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফেন হ্যাম্পসন বলেন, “এটি শুধু প্রতিরক্ষা নয়, বরং শিল্পনীতি, মৈত্রী ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় নিরাপত্তার সমন্বিত সিদ্ধান্ত — যা এখন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সম্পৃক্ততা দাবি করে।”
এক দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত
এই চুক্তি কানাডার প্রতিরক্ষা ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করতে পারে। ইউরোপ বা এশিয়া — যাকেই বেছে নিক না কেন, কার্নির সিদ্ধান্ত আগামী পঞ্চাশ বছরের জন্য কানাডার বৈদেশিক কৌশল ও সামরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করবে।
#কানাডা #সাবমেরিন_চুক্তি #দক্ষিণ_কোরিয়া #প্রতিরক্ষা #মার্ক_কার্নি #ইন্দো_প্যাসিফিক #হানহওয়া_ওশেন #জার্মানি_নরওয়ে
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















