বেথলেহেমে পর্যটনের পতন
একসময় বেথলেহেমের ট্যুর গাইড নূর আওয়াদের একদিনেই ২২০টিরও বেশি পর্যটকবাহী বাস আসত। এখন তা নেমে এসেছে মাত্র পাঁচটিতে। গির্জা, ঐতিহাসিক স্থান ও ধর্মীয় নিদর্শনের শহরটি এখন প্রায় পর্যটকশূন্য। আওয়াদ বলেন, ‘আসলে এখন কোনো পর্যটনই নেই।’
দুই বছরের যুদ্ধ, হামাস ও ইসরায়েলের সংঘর্ষ, এবং চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় একসময়ের ১০ বিলিয়ন ডলারের ইসরায়েলি পর্যটন শিল্প কার্যত ভেঙে পড়েছে। ২০২৪ সালে পর্যটক সংখ্যা ছিল ২০১৯ সালের মাত্র ২০ শতাংশ। তারও এক-তৃতীয়াংশ ছিল পারিবারিক সাক্ষাতে আসা মানুষ।
আশার আলো—যুদ্ধবিরতির পর নতুন প্রস্তুতি
সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির পর ধীরে ধীরে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখা দিচ্ছে। বেথলেহেমের আরেক গাইড ও দোকানমালিক জিয়াদ বান্দাক বলেন, ‘আমি কিছুটা আশাবাদী হতে শুরু করেছি।’ তাঁর দোকানে এখন মাঝে মাঝে রোমানিয়া থেকে আসা পর্যটকদের দেখা যায়।

জেরুজালেম ও তেল আবিবের ট্যুর অফিসগুলিতেও ফোন বেজে উঠছে। তেল আবিবভিত্তিক ট্রাভেল এজেন্সি ‘অর্ট্রা’র প্রধান নির্বাহী লিওর গেলফান্ড জানান, গত কয়েক দিনে নতুন দুটি গ্রুপ ট্যুরে নাম লিখিয়েছে। ‘এটা বিশাল কিছু নয়, তবে এটা একটা ভালো লক্ষণ,’ বলেন তিনি। ‘আমাদের বিপর্যস্ত শিল্পের জন্য এটা হতে পারে এক মোড় ঘোরানো সময়।’
বিদেশি পর্যটক ফেরাতে বড় প্রচারণা
ইসরায়েলের পর্যটন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৫ সালে পর্যটকের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ বাড়বে বলে তারা আশা করছে। এরই মধ্যে এয়ার কানাডাসহ একাধিক এয়ারলাইন তাদের ফ্লাইট পুনরায় চালু করেছে।
পর্যটন মন্ত্রণালয় উত্তর আমেরিকার ইহুদি ও ইভানজেলিকাল সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ৪.২৫ মিলিয়ন ডলারের একটি নতুন বিপণন প্রচারণা শুরু করছে। মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, এই প্রচারণার লক্ষ্য ‘ইসরায়েলকে আবারও একটি আকর্ষণীয়, অতিথিপরায়ণ ও নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।’
যুদ্ধোত্তর ভাবমূর্তির চ্যালেঞ্জ
তবে বড় প্রশ্ন হলো—ইসরায়েল কি আগের অবস্থানে ফিরতে পারবে? পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দাবি, যুদ্ধে কোনো বিদেশি পর্যটক আহত হয়নি। কিন্তু যুদ্ধকালীন গণহত্যার অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারের হুমকি ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ — সব মিলিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
লিওর গেলফান্ডের মতে, পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বহু মানুষ ইসরায়েলে আর ভ্রমণ করতে চান না। ‘অনেকে বলছেন, আমরা জানি এখন শান্ত, কিন্তু আমরা এখানে টাকা খরচ করব না। কেউ কেউ বলেন, “আমি ইসরায়েলে এক ডলারও খরচ করব না।”’

এই পরিস্থিতিতে নতুন বাজার খুঁজে বের করার পরামর্শ দিচ্ছেন গেলফান্ড। তাঁর মতে, মুখে মুখে ইতিবাচক প্রচার কিছুটা কাজে লাগতে পারে। পাশাপাশি, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো হতে পারে বড় পরিবর্তনের সূচনা।
মুসলিম পর্যটকদের আকর্ষণ—নতুন ভাবনা
আব্রাহাম চুক্তির পর সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। গেলফান্ড আশা করছেন, সৌদি আরবও সেই পথে এগোবে। তাঁর মতে, ‘যদি জেরুজালেম মুসলিম পর্যটকদের জন্যও গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে, এটা হবে এক বড় গেমচেঞ্জার।’
তবে বাস্তবতা জটিল। মুসলিম পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান আল-আকসা মসজিদ, যেখানে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা সবসময় তীব্র। জেরুজালেম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলের মালিক ওমর আতাল্লাহ জানান, ‘যদি আরব দেশ থেকে কোনো মুসলিম দল আসে, মসজিদের ভেতরে থাকা কিছু গোষ্ঠী তা ভালোভাবে নাও নিতে পারে। কেউ কেউ তাদের ওপর পাথর বা জুতা ছুঁড়তেও পারে।’
আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
আতাল্লাহর মতে, ইসরায়েল নিজেই তার রক্তাক্ত ভাবমূর্তি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। সরকার বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষকে এনে হামাসের ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালের আক্রমণের ক্ষয়ক্ষতির স্থান দেখাচ্ছে — যা আসলে পর্যটন প্রচারের পরিবর্তে যুদ্ধের বিভীষিকা প্রদর্শন করছে।
তিনি বলেন, ‘তারা যদি এই অর্থ ব্যয় করত তেল আবিব বা দেশের অন্য সুন্দর স্থানগুলো দেখাতে, তাহলে বিদেশিদের ধারণা অনেকটাই বদলাত।’

শেষ আশা—ধর্মীয় তীর্থযাত্রী
অনেক পর্যটন উদ্যোক্তা এখন আশা করছেন, অন্তত ধর্মীয় তীর্থযাত্রীরা আবার ফিরবেন। কারণ জেরুজালেম, নাজারেথ ও বেথলেহেম পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে পাওয়া যায় না — এগুলোই ‘পবিত্র ভূমি’।
আতাল্লাহ বলেন, ‘তীর্থযাত্রীরা আসবেই, এটা ঠিক যেমন বলা হয়, “তুমি যদি তা তৈরি করো, তারা আসবেই।” আসলে সবই তৈরি আছে — তাদের আসা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।’
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















