প্রযুক্তির চাপে শৈশবের হারানো সময়
টরোন্টোর সফটওয়্যার ডিজাইনার ডেভ পেলেটিয়ার চান, তার ছোট মেয়ে আরও কয়েক বছর যেন স্মার্টফোন থেকে দূরে থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো, অন্য অভিভাবকেরা যখন সন্তানদের হাতে ফোন দিচ্ছেন, তখন সেই সামাজিক চাপ প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
এই কারণেই তিনি সই করেছেন ‘আনপ্লাগড কানাডা’ নামের এক নাগরিক উদ্যোগের অঙ্গীকারপত্রে, যেখানে ১৪ বছর বয়সের আগে কোনো শিশুকে স্মার্টফোন না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
‘আনপ্লাগড কানাডা’: এক যৌথ আন্দোলন
প্রায় এক বছর আগে শুরু হওয়া এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো—শৈশবকে পর্দামুক্ত রাখা ও বাস্তব জীবনের বন্ধন জোরদার করা। সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা ও মনোবিদ মিশেল লক বলেন, “এই প্রতিশ্রুতি আসলে এক ধরনের যৌথ সমাধান। অভিভাবকরা নিজেরাই বুঝতে পারেন যে কঠিন হলেও এটা সম্ভব—আর যত বেশি মানুষ এতে যোগ দেন, কাজটা তত সহজ হয়।”

ডেভ পেলেটিয়ার বলেন, “নীতিগত পরিবর্তনই এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। সরকারের উচিত এই প্রযুক্তির জন্য ন্যূনতম বয়সসীমা নির্ধারণ করা।”
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি
শিশুদের হাতে স্মার্টফোনের ক্ষতির দিকগুলো এখন সুপরিচিত—সময় নষ্ট হওয়া, অনলাইন আসক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি।
‘আনপ্লাগড কানাডা’-এর টরোন্টো অধ্যায়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা রেবেকা স্নো উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজমনোবিজ্ঞানী জনাথন হেইড্ট-এর বই ‘দ্য অ্যানক্সিয়াস জেনারেশন’ অভিভাবকদের জন্য এক সতর্কবার্তা।
বইটিতে হেইড্ট স্মার্টফোনকে বলেছেন “অভিজ্ঞতা রোধকারী”, যা শিশুদের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মেলামেশাকে বাধাগ্রস্ত করে।
স্নো বলেন, “তিনি বইয়ে আরও একটি তীব্র বৈপরীত্য তুলে ধরেছেন—আমরা শিশুদের ১৫ মিনিট অনলাইনে থাকতে দিই, অথচ আশপাশে ১০ মিনিট একা হাঁটতে দিই না।”
আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত ও আইনগত দাবি
ডেনমার্ক সরকার ১৫ বছরের নিচে শিশুদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছে। অস্ট্রেলিয়াও ১৬ বছরের নিচের শিশুদের জন্য এমন নিষেধাজ্ঞা ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করতে যাচ্ছে।
‘আনপ্লাগড কানাডা’ আশা করছে, ফেডারেল সরকারও এ ধরনের আইন প্রণয়নে পদক্ষেপ নেবে।
সামাজিক চাপে ঐক্যবদ্ধ অভিভাবকরা
এ পর্যন্ত প্রায় ৫,০০০ জন অভিভাবক এই অঙ্গীকারে সই করেছেন।
টরোন্টোর পারিবারিক চিকিৎসক ও দুই সন্তানের মা এলিসন ইয়াং বলেন, “এই উদ্যোগ মূলত শিক্ষার ও সচেতনতার একটি পথ। এটি শিশুদের জানায় যে তারা একা নয়, ফলে অভিভাবকদের জন্য ফোন দেওয়া বিলম্বিত করা সহজ হয়।”

অন্যদিকে, কেট ও’কনর ও তার এক বন্ধু পশ্চিম টরোন্টোর পাড়ায় ‘হোল্ড দ্য ফোন’ শিরোনামে পোস্টার লাগিয়েছেন—“চলুন এমন এক সমাজ গড়ি যেখানে শিশুরা ফোনমুক্ত বন্ধুত্বে বড় হবে, আর অভিভাবকেরা একে অপরকে সহযোগিতা করবেন।”
ও’কনর বলেন, “সব অভিভাবকই একই জিনিস চান—খুশি, আত্মবিশ্বাসী ও মানসিকভাবে সুস্থ সন্তান।”
বাস্তব জীবনে ফোনহীনতার চ্যালেঞ্জ
ডেভ পেলেটিয়ারের ১২ বছর বয়সী মেয়ে ও ১০ বছর বয়সী ছেলে এখনো ফোন চায়নি। “ওরা জানে আমরা এই বিষয়ে কতটা সচেতন,” তিনি বলেন।
তবে কিছু অসুবিধাও আছে—তার মেয়ে ক্লাসের বাচ্চাদের গ্রুপ চ্যাটে নেই, ফলে অনলাইন আলাপ থেকে দূরে থাকে।
অস্বস্তিকর মুহূর্তও তৈরি হয়—বন্ধুরা যখন ফোনে ব্যস্ত, সে তখন একা বসে থাকে।
সম্প্রতি মেয়েটি নিজস্ব সমাধান খুঁজে পেয়েছে—
“সে বই পড়তে ভালোবাসে,” পেলেটিয়ার বলেন, “তাই এখন সে তার কোবো ইরিডার সঙ্গে রাখে। বন্ধুরা যখন স্ক্রিনে মগ্ন থাকে, তখন সে বই খুলে পড়া শুরু করে—যতক্ষণ না তারা ফোন নামায়।”
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা শিশুদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলছে। তবে ‘আনপ্লাগড কানাডা’-এর মতো উদ্যোগ দেখাচ্ছে, অভিভাবকেরা একসঙ্গে থাকলে শৈশবকে এখনো রক্ষা করা সম্ভব—একটি স্ক্রিনমুক্ত বাস্তব জীবনের পৃথিবীতে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















