নায়াগ্রা ফলসের মারিনল্যান্ডে বেলুগাদের সংকট
কানাডার অন্টারিও প্রদেশের নায়াগ্রা ফলস শহরের বিখ্যাত বিনোদন পার্ক ‘মারিনল্যান্ড’ ২০২৪ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। সেখানে এখনো আটকে আছে ৩০টি বেলুগা তিমি যাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চলছে তীব্র বিতর্ক। বহু বছর ধরেই প্রাণী অধিকার সংস্থাগুলো পার্কটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে আসছে—অমানবিক বন্দিদশা ও প্রাণী নির্যাতনের কারণে।

প্রাণ বাঁচাতে চীনে পাঠানোর প্রস্তাব
অন্টারিওর সলিসিটর জেনারেল মাইকেল কার্জনার ফেডারেল সরকারকে অনুরোধ করেছেন, এই ৩০টি বেলুগা তিমি চীনের চিমলং ওশেন কিংডমে রফতানির জন্য মারিনল্যান্ডের আবেদনটি পুনর্বিবেচনা করতে। তার মতে, এটি প্রাণীগুলোর বেঁচে থাকার অন্যতম শেষ উপায়।
তিনি জানান, তিনি সরাসরি ফেডারেল মৎস্যমন্ত্রী জোয়ান থম্পসনের সঙ্গে কথা বলেছেন তিমিগুলোর ভাগ্য নিয়ে। কিন্তু থম্পসন আগেই এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন, কারণ কানাডার আইনে প্রাণীদের বিনোদনমূলক কাজে ব্যবহারের অনুমতি নেই এবং চীনে পাঠানো হলে তাদের বন্দিদশা অব্যাহত থাকবে।
কার্জনার সতর্ক করেছেন, “সময় ফুরিয়ে আসছে, আর বিকল্পও সীমিত। যদি চীনে পাঠানোই বেলুগাগুলোর জীবিত থাকার একমাত্র উপায় হয়, তবে সেটি বিবেচনা করা উচিত।”
সরকারের মধ্যে মতবিরোধ
ফেডারেল মন্ত্রী থম্পসনের মুখপাত্র এরিক নোসালুক বলেছেন, “মন্ত্রী তার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। যদি মারিনল্যান্ড নতুন করে রফতানি অনুমতির আবেদন করে, তবে তা বিজ্ঞান, প্রাণীকল্যাণ ও আইনি কাঠামোর ভিত্তিতে দ্রুত পর্যালোচনা করা হবে।”
তবে অন্টারিও সরকার মনে করছে, প্রাণীগুলোর অস্তিত্ব এখন ঝুঁকিতে, এবং ফেডারেল পর্যায়ে পুনর্বিবেচনা জরুরি। কার্জনার ও প্রিমিয়ার ডগ ফোর্ড দুজনেই বলেছেন, তারা চান বেলুগাগুলো টিকে থাকুক এবং স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে যাক।
দায়িত্ব নিয়ে কেন্দ্র ও প্রদেশের ‘দোষারোপ’
মারিনল্যান্ডে বর্তমানে প্রাণীগুলোর দায়িত্ব কার — এই প্রশ্নে কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে দোষারোপ চলছে। ২০১৯ সাল থেকে সেখানে ১৯টি বেলুগা, একটি কিলার হোয়েল এবং একটি ডলফিন মারা গেছে। যদিও কোম্পানিটি দাবি করেছে, এসব মৃত্যু ‘প্রাকৃতিক জীবনচক্রের অংশ’।

মারিনল্যান্ড মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও আগে তারা বলেছিল, রফতানি অনুমতি না দেওয়া মানে বেলুগাগুলোকে বিশ্বের কোনো অ্যাকোয়ারিয়ামেও পাঠানো সম্ভব হবে না।
বিকল্প হিসেবে নোভা স্কোশিয়ার ‘হোয়েল স্যাংচুয়ারি’
এরই মধ্যে নোভা স্কোশিয়া প্রদেশে উত্তর আমেরিকার প্রথম ‘হোয়েল স্যাংচুয়ারি’ নির্মাণের পরিকল্পনা অনুমোদন পেয়েছে। ‘হোয়েল স্যাংচুয়ারি প্রজেক্ট’ নামের মার্কিন প্রতিষ্ঠানটিকে ২০ বছরের জন্য সরকারি জমি ইজারা দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির আওতায় ১৮ মিটার গভীর ও ১০০ একর জায়গাজুড়ে প্রাকৃতিক জলের মধ্যে তিমিদের মুক্তভাবে রাখার ব্যবস্থা থাকবে।
প্রকল্পটির আনুমানিক ব্যয় ১ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার এবং বার্ষিক পরিচালন ব্যয় ২০ লাখ ডলার। তবে প্রাথমিকভাবে তারা মাত্র আটটি তিমিকে স্থান দিতে পারবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী চার্লস ভিনিক।
ফেডারেল মন্ত্রী থম্পসন বলেছেন, “মানুষের এই উদ্যোগ হৃদয়গ্রাহী। আমি যে কোনো সমাধান বিবেচনা করতে প্রস্তুত।”
জরুরি তহবিল প্রত্যাখ্যান ও নৈতিক বিতর্ক
মারিনল্যান্ড ফেডারেল সরকারের কাছে জরুরি অর্থায়নের আবেদন করেছিল, কিন্তু সেটিও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কর্তৃপক্ষ সতর্ক করেছে, অনুমতি না মিললে বেলুগাগুলোর ‘ইউথেনেশিয়া’ (জীবন সমাপ্তি) ঘটাতে হতে পারে।
নায়াগ্রা ফলসের প্রাদেশিক এনডিপি সদস্য ওয়েন গেটস অভিযোগ করেছেন, “অন্টারিও সরকার প্রাণীকল্যাণের দায়িত্ব এড়াচ্ছে। আবার বেলুগাগুলোকে চীনে পাঠানোও বিপজ্জনক, কারণ তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা প্রকাশ করা হয়নি।”
প্রাণী অধিকারকর্মীদের অবস্থান
‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমেল প্রোটেকশন’ সংগঠনের ক্যাম্পেইন পরিচালক মেলিসা ম্যাটলো বলেন, “চীনে পাঠিয়ে বিনোদনের জন্য তাদের ব্যবহার করা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। কানাডা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

তার মতে, নোভা স্কোশিয়ার স্যাংচুয়ারি প্রকল্পই সবচেয়ে মানবিক পথ, যা বেলুগাগুলোর প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে।
মারিনল্যান্ডের আর্থিক সংকট, সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও নৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে বেলুগা তিমিগুলোর ভাগ্য এখন অনিশ্চিত। ফেডারেল সরকার আইন ও নীতিমালার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকলেও, প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ বাস্তবিক সমাধানের দাবি তুলছে — যেখানে প্রাণীগুলোর জীবনের প্রশ্নটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
#সমুদ্রজীবন #প্রাণীকল্যাণ #কানাডা #মারিনল্যান্ড #বেলুগা #অন্টারিও #নোভাস্কোশিয়া
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















