১৯৮০–এর দশকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নজরে যে জাপান ধরা পড়েছিল, সেটি ছিল ঝলমলে আড়ম্বর আর বড় স্বপ্নের দেশ—এতটাই অর্থবিত্তশালী যে ব্যবসায়ীরা হোস্টেস বারে ১৪ হাজার ডলার পর্যন্ত বকশিশ দিতেন এবং গলফ ক্লাবের সদস্যপদের খরচ ছুঁত ৩০ লাখ ডলারেরও বেশি। সে সময় ফেরারি ও মার্সিডিজ–বেঞ্জের বিলাসবহুল গাড়ির বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল হু হু করে। জমির দাম এতটা উচ্চতায় উঠেছিল যে টোকিওর কেন্দ্রে সামান্য বেশি ১ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে থাকা ইম্পেরিয়াল প্যালেসের প্রাঙ্গণের মূল্য ক্যালিফোর্নিয়ার সব রিয়েল–এস্টেটের মোট মূল্যকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এই সময়েই ত্রিশোর্ধ্ব রিয়েল–এস্টেট উদ্যোক্তা ট্রাম্প নিউইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউতে নিজের নামে সোনালি টাওয়ার তুললেন, আর জাপানি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে দখল নিল প্রথম সারির সম্পত্তি—ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের কাছে রকফেলার সেন্টারসহ বহু স্থাপনা। উদ্ভাবনেও জাপান ছিল বিশ্বনেতা: সনি ওয়াকম্যান, ভিসিআর এবং নিন্টেন্ডো গেমস—সবই তাদের সৃষ্টি। মনে হচ্ছিল ভবিষ্যৎ যেন জাপানেরই দখলে। খ্যাতনামা হার্ভার্ডের এক অধ্যাপক তখন বইও লিখেছিলেন—“জাপান অ্যাজ নাম্বার ওয়ান”—এতটাই নিশ্চিত মনে হচ্ছিল যে জাপান যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হবে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, এই ‘সেই জাপান’–এরই ধারণা ট্রাম্পের বর্তমান শুল্কনীতির ভিত—দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি যেটি ব্যবহার করছেন বৈশ্বিক অর্থনীতি নতুন করে সাজাতে এবং, তাঁর ভাষায়, ধনী অর্থনীতিগুলোর ‘যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকানো’ বন্ধ করতে। ১৯৯০ সালে প্লেবয় পত্রিকাকে ট্রাম্প বলেছিলেন, “আগে তারা আমাদের ভোক্তা–পণ্য দিয়ে সব টাকা নিয়ে যায়, তারপর সেই টাকা দিয়ে ম্যানহাটনের সব কিনে ফেলে। তাই যেভাবেই হোক, আমরা হারি।” তাঁর সমাধান—তখনও, এখনো—শুল্ক।

কিন্তু আজকের জাপান আর ট্রাম্পের স্মৃতির সেই জল্পনাভিত্তিক ‘দ্রুতগতির’ জাপান নয়। আজ জাপান বিশ্বের অর্থনীতিতে চতুর্থ। ট্রাম্প তাঁর বর্তমান মেয়াদে প্রথমবারের মতো সোমবার টোকিওয় পৌঁছাবেন। সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির সঙ্গে তাঁর আলোচনায় উঠতে পারে যুক্তরাষ্ট্র–জাপান বাণিজ্য চুক্তি—যার অধীনে জাপান যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা সব পণ্যে ১৫ শতাংশ শুল্ক মেনে নিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের শুল্কনীতি আটকে আছে চার দশক আগের প্রতিযোগিতার যুগে। টেম্পল ইউনিভার্সিটির জাপান ক্যাম্পাসের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি বিশেষজ্ঞ পল ন্যাডো বলেন, “জাপানকে তিনি কখনোই ‘সমকক্ষ চ্যালেঞ্জার’–এর ধারণা থেকে ছাড়েননি… অথচ জাপান এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। তিনি সেটা কখনো পেরোতে পারেননি।” ১৯৯১ সালে সম্পত্তি–বুদ্বুদ ফেটে যাওয়ার পর থেকে যে–কোনো জাপানি প্রধানমন্ত্রী যেমন প্রতিশ্রুতি দেন, তাকাইচিও তেমনি জাপানের অর্থনীতিকে নতুনভাবে চাঙ্গা করার অঙ্গীকার করেছেন।
১৯৯১ সালে অতিমূল্যায়িত শেয়ার ও জমির দাম জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কড়াভাবে বাড়ালে ধসে পড়ে। শুরু হয় আর্থিক সংকট, যা টেনে নিয়ে যায় তিন দশকেরও বেশি সময়ের দীর্ঘ স্থবিরতায়—যাকে বলা হয় “হারিয়ে যাওয়া দশকসমূহ”, প্রায় শূন্য প্রবৃদ্ধির যুগ। করপোরেট খাত বিনিয়োগে কুণ্ঠিত হয়; চাহিদা হোঁচট খেয়ে পড়ে এবং শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদি মূল্য–পতন। ১৯৯০–এর দশকের শেষের এশিয়ান মুদ্রা–সংকট, একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিও এই মন্দায় ভূমিকা রাখে।
এখন জাপান মোকাবিলা করছে বহু অর্থনৈতিক সমস্যার: দ্রুত বয়স্ক ও সংকুচিত জনসংখ্যা—১২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের প্রায় ৩০ শতাংশই ৬৫–এর ওপরে। জনসংখ্যা হ্রাস ও কম প্রজননহারের ফলে তীব্র শ্রমিক–সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যা ঐতিহ্যগতভাবে অভিবাসন–সংকোচী একসময়ের একরূপী সমাজে আগে কখনো না দেখা মাত্রায় বিদেশি শ্রমিকের দরজা খুলে দিয়েছে। মুদ্রা দুর্বল। “হারিয়ে যাওয়া” তিন দশকের পর অবশেষে দামে ঊর্ধ্বগতি শুরু হওয়ায় বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়–সংকট। আর অটোমোবাইল শিল্প—যা ১৯৮০–এর দশকে এবং বর্তমান দ্বিতীয় ট্রাম্প আমলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য–ঘর্ষণের উৎস—এখন গাড়ি রপ্তানিতে চীনের পেছনে, বিশেষত যখন বিশ্ব ইলেকট্রিক গাড়ির দিকে ঝুঁকছে।
জাপান এখন দ্রুত প্রবৃদ্ধির চেয়ে সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বেশি পরিচিত—অসাধারণ সময়নিষ্ঠ ট্রেন, ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তা এবং সামাজিক সম্প্রীতির গভীর সংস্কৃতি। তবে টানা তিন দশকের বেশি সময়ের মন্থর প্রবৃদ্ধি মানে ১৯৮০–এর বিলাস–কেন্দ্রিক জাপানের গল্পগুলো এখন দূর–অতীত। অর্থনীতিবিদ জেসপার কোল, যিনি ১৯৮৬ সাল থেকে জাপানে থাকেন, বলেন, “পেছন ফিরে দেখলে, অহমিকা স্পষ্ট ছিল।”
১৯৮৭ সালে মাথাপিছু জিডিপিতে জাপান যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেলে আমেরিকানদের নিজেদের বিশ্বে অবস্থান–বোধে বড় পরিবর্তন আসে। কোল বলেন, “বুদ্বুদের সময় জাপানিদের কাছে ক্রমাগত হার মানার ঈর্ষেটা ছিলই। সেটাই ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিকে গড়েছে—জাপান দেখিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা যায়।” তাঁর ভাষায়, “জার্মানদের গাড়ি ছিল, কিন্তু তারা আপনার বসার ঘরে ঢোকেনি, আপনার বাড়িওয়ালা হয়নি। জাপানিরা ছিল—তারা আপনার গাড়ি বানাত, আপনার বসার ঘরে তাদের পণ্য থাকত, তারাই আপনার বাড়িওয়ালা হতো।”
জাপানি সংস্কৃতি ও পণ্যের প্রতি আমেরিকার টান যেমন বাড়ছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি ধীরে ধীরে ক্ষীণ হচ্ছিল, তেমনি জাপানের অর্থনৈতিক উত্থান নিয়ে উদ্বেগের ঢেউ বয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। ১৯৮৭ সালে কংগ্রেসের কয়েকজন সদস্য ক্যাপিটল–চত্বরে স্লেজহ্যামার দিয়ে একটি তোশিবা রেডিও ভেঙে জাপানি ইলেকট্রনিকস কোম্পানির প্রতি তাদের ক্ষোভ দেখান।

তখন নিউইয়র্কের রিয়েল–এস্টেট ব্যবসায়ী ট্রাম্প সেই অস্বস্তিকেই আঁকড়ে ধরেন। ১৯৮৭ সালে তিনি প্রায় এক লাখ ডলার খরচ করে ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস ও বোস্টন গ্লোবে পূর্ণপাতার বিজ্ঞাপন ছাপান—অভিযোগ করেন, “দশকের পর দশক ধরে জাপান ও আরও অনেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগে খাটো করছে” নিজেদের প্রতিরক্ষায় যথেষ্ট খরচ না করে। তাঁর যুক্তি ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত “ধনী দেশগুলোর ওপর কর” বসানো—যেমন জাপান, যারা “অভূতপূর্ব উদ্বৃত্ত দিয়ে শক্তিশালী ও উদ্দীপ্ত অর্থনীতি গড়ে তুলেছে।”
দ্বিতীয় মেয়াদে এসে ট্রাম্প সেই পন্থাই আরও জোরের সঙ্গে প্রয়োগ করছেন—ধনী–গরিব নির্বিশেষে দেশগুলোর ওপর শুল্ক চাপিয়ে। বিশেষত চীনের দিকে তাঁর কড়া নজর—যে দেশটি এখন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লাইনে—আগ্রাসী শুল্কবৃদ্ধির হুমকি দিয়েছেন এবং চীনের আধুনিক কম্পিউটার চিপ প্রাপ্তিতে কঠোর রপ্তানি–নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়িয়েছেন।
তবে সুসংবাদ হলো, শুল্ক—এবং জাপান—নিয়ে ট্রাম্পের বর্তমান অবস্থানও নরম করা সম্ভব। ন্যাডোর ভাষায়, প্রথম মেয়াদে যখন ট্রাম্প জোটের মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং জাপানে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের জন্য বেশি খরচ বহনের দাবি করেছিলেন, তখনও তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছিলেন—প্রশংসা ও গলফ–কূটনীতির মাধ্যমে আবে ট্রাম্পের জাপানবিরোধী আবেগ সামলাতে পেরেছিলেন। ট্রাম্পের দ্বিতীয় প্রশাসনেও অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এবং মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ারের মতো কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্র–জাপান বাণিজ্য সম্পর্কে আরও সূক্ষ্মতা এনেছেন, বলেন ন্যাডো।
এর মধ্যে কিছু বিষয় ট্রাম্পের পক্ষে গেলও। ১৯৯০ সালে ট্রাম্প টোকিওয় গিয়েছিলেন জাপানি ব্যাংকারদের সঙ্গে বৈঠক করতে এবং মাইক টাইসনের বক্সিং লড়াই দেখতে। ১৯৯৩ সালের “লস্ট টাইকুন: দ্য মেনি লাইভস অব ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প” বইয়ের ভাষ্য, তিনি কাঁচা মাছ খেতে অস্বীকার করে ম্যাকডোনাল্ড’স–ই খেয়েছিলেন। ইম্পেরিয়াল গার্ডেনে হাঁটতে গিয়ে তিনি সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে চান এবং সাঙ্গপাঙ্গদের নির্দেশ দেন সাক্ষাৎ ঠিক করতে। বইটির মতে, সম্রাটের মুখপাত্র তখন জানিয়েছিলেন, তিনি কে তা জানা নেই; লিখিত আবেদন দিলে এক বছরের মধ্যে হয়তো সাক্ষাৎ নির্ধারণ করা যেতে পারে।
এই সপ্তাহে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে টোকিওয় ফিরছেন। আর এবার তাঁর সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎের সময়–তারিখ ঠিক আছে—আসলে এটি হবে তাঁদের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ।
( এই লেখা যখন প্রকাশিত হচ্ছে তখন ট্রাম্প জাপানে)
মিশেল ইয়ে হি লি 


















