কূটনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রে এশিয়া
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সপ্তাহে তাঁর এশিয়া সফর শুরু করেছেন, যেখানে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করবেন। তবে এই সফর কেবল দুই নেতার বৈঠক নয়—এটি এমন এক অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা দ্রুতই বেইজিং ও ওয়াশিংটনের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার মঞ্চে পরিণত হয়েছে।
এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন শুধু সামরিক শক্তি বা কূটনৈতিক উপস্থিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি ছড়িয়ে পড়েছে সরবরাহ শৃঙ্খল, প্রযুক্তি, বন্দর উন্নয়ন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পর্যন্ত। দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো এখন এই প্রতিযোগিতায় নিজেদের কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষায় ব্যস্ত।
প্রভাব ও কৌশলের পাল্টা খেলা
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক জা ইয়ান চং বলেছেন,“এশিয়ার দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কৌশলগত প্রতিযোগিতায় কেবল দর্শক হতে চায় না। তারা চায় উভয় পরাশক্তিই তাদের প্রতি আগ্রহ দেখাক, যাতে তারা উভয় দিক থেকেই লাভবান হতে পারে।”
কিন্তু পরিস্থিতি আগের চেয়ে জটিল। অতীতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফর মানেই ছিল এশিয়ার মিত্রদের জন্য আশ্বস্ত বার্তা—যে যুক্তরাষ্ট্র চীনের উত্থানের বিরুদ্ধে পাশে রয়েছে। অথচ এবার ট্রাম্পের সফরে সেই বার্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাণিজ্য শুল্ক, সামরিক প্রতিশ্রুতি এবং কূটনৈতিক টানাপোড়েন এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

বাণিজ্য, রেয়ার আর্থ ও ক্ষমতার ভারসাম্য
বেইজিং এখন এই অনিশ্চয়তার সুযোগ নিচ্ছে। তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে নতুন চুক্তি করছে, নিজেদেরকে “স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য” অংশীদার হিসেবে তুলে ধরছে।
চীন সতর্ক করেছে—যেসব দেশ ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবে, তারা বাণিজ্যিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
আসন্ন এপেক সম্মেলনে ট্রাম্প ও শি জিনপিংয়ের বৈঠককে তাই বিশ্ব অর্থনীতির দিকনির্দেশক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ট্রাম্প চাইছেন, চীন যেন রেয়ার আর্থ রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিপণ্য আমদানি পুনরায় শুরু করে এবং ফেন্টানিল তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনে। অপরদিকে শি জিনপিং আশা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক কমাবে, সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার দেবে এবং চীনা বিনিয়োগে বিধিনিষেধ শিথিল করবে।
রেয়ার আর্থে চীনের কৌশলগত প্রভাব
রেয়ার আর্থ খনিজ রপ্তানিতে চীনের নিয়ন্ত্রণ এখন তাদের বড় কূটনৈতিক অস্ত্র। আধুনিক প্রযুক্তি উৎপাদনে এসব খনিজ অপরিহার্য, অথচ যুক্তরাষ্ট্র এখনও নির্ভরযোগ্য বিকল্প উৎস খুঁজে পায়নি।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ চীনের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে—কারণ এটি এমন সময়ে এসেছে, যখন চীন নিজেকে “সহযোগিতামূলক ও পরিবেশবান্ধব” শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি সংকটে
ট্রাম্পের সফরকে ঘিরে এশিয়ার দেশগুলোতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেক দেশ এখনো আগের শুল্কনীতির প্রভাব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এর পাশাপাশি, ওয়াশিংটনের বৈদেশিক সহায়তা কমানো এবং গাজা যুদ্ধের সময় ইসরায়েলের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে ক্ষোভ বাড়িয়েছে।
মালয়েশিয়ায় ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা এতটাই কম যে, প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম স্পষ্ট করে জানিয়েছেন—এই আমন্ত্রণ এসেছে আসিয়ান জোটের পক্ষ থেকে, মালয়েশিয়ার নয়।
অনিশ্চয়তার মধ্যে নতুন জোট
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের বিশ্লেষক লিন কুয়ক বলেন,“যুক্তরাষ্ট্রের অস্থির অবস্থান দেখে অনেক দেশ এখন গালফ অঞ্চল ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। কিন্তু একই সঙ্গে চীনের ভৌগোলিক নিকটতা ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা তাদের বেইজিংয়ের দিকেই টানছে।”
চীন দীর্ঘদিন ধরে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শূন্যস্থানটি এখন চীন কৌশলগতভাবে পূরণ করছে।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান
ট্রাম্প তাঁর সফরে জাপানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তাকাইচি শুরুতে কঠোর অবস্থান নিলেও সাম্প্রতিক সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি রক্ষায় নরম কূটনীতি অবলম্বন করেছেন।
দক্ষিণ কোরিয়া এখন দ্বৈত চাপের মধ্যে—নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা, আর বাণিজ্যের জন্য চীনের ওপর। দেশটির প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন,“দুই পরাশক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা এখন ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।”
এশিয়ার ভবিষ্যৎ কূটনীতির পরীক্ষায়
ট্রাম্প ও শি জিনপিংয়ের এই সাক্ষাৎ শুধু দুই দেশের নয়, সমগ্র এশিয়ার ভবিষ্যৎ কৌশলগত দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করতে পারে। বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও ভূরাজনীতির জটিল এই সমীকরণে প্রতিটি দেশকেই এখন সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে, যাতে তারা পরাশক্তির প্রতিযোগিতায় নিজেদের স্বার্থ হারিয়ে না ফেলে।
#ট্রাম্প_শি_জিনপিং #চীন_মার্কিন_প্রতিদ্বন্দ্বিতা #এশিয়া_নীতি #রেয়ার_আর্থ #বাণিজ্য_যুদ্ধ #আসিয়ান #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















