পাবনার হৃদয়ে বয়ে চলেছে এক নদী—ইছামতি। একসময় বাণিজ্য, পরিবহন, মাছ ও মানুষের মেলবন্ধনের জায়গা ছিল এই নদী। কিন্তু আধুনিকতার ছোবলে, অব্যবস্থাপনা ও উপেক্ষার কারণে আজ প্রায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তবু থেমে নেই ফিরে আসার আশা। এই ফিচারে আমরা পাবনা জেলার ইছামতি নদীর ইতিহাস, গুরুত্ব, আজকের অবস্থা ও আগামী সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
নদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও ভৌগোলিক পরিকাঠামো
ইছামতি নদী (পাবনা) বাংলাদেশের পাবনা জেলা দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। পাবনা শহর নদীর তীরে গড়ে উঠেছে—এমন তথ্যও রয়েছে। এই নদী কয়েক দশক আগে বাড়তি নৌবহন ও পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পাবনায় এই নদীর জীববৈচিত্র্য ও পানির গুণগত মান এখন অনেক খারাপ পর্যায়ে রয়েছে।
ইতিহাস: বাণিজ্য ও সামাজিক জীবনের অঙ্গ
ইছামতি নদীর তীরে একসময় রপ্তানি, আমদানি ও নৌযান চলাচল ছিল সুনিশ্চিত। পাবনা শহরের কারখানা, হাটবাজার ও স্থানীয় লোকজ জীবন নদীর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল। শহরের লুপ্ত-শহিদ বনে নদীর তীরের জীবন ছিল রঙিন—মৎস্যজীবী, নৌবহনকারী, বিক্রেতা, শিশুরা নদীতে খেলা—সবাই একসাথে।
এই নদীতে মাছ ধরাই ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ আয়-উপার্জনের উৎস। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নদীর অবস্থা পরিবর্তিত হয়। নগরায়ন, অবৈধ দখল, বর্জ্য ফেলা ও অবহেলার কারণে নদীর প্রাণ সরে যায়।
গুরুত্ব: পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও অর্থনৈতিক দিক
নদীর পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক।
- মৎস্যজীবন: একসময় প্রচুর মাছ থাকত এই নদীতে, যা স্থানীয় মানুষদের জীবিকা দিত।
- পরিবহন: নদীর পানি নৌযান চলাচল সুগম করত, পণ্য ও মানুষের চলাচল সহজ হত।
- বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ: নদী এলাকার জমিতে সেচ এবং বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে সাহায্য করত।
- সামাজিক–সাংস্কৃতিক: নদীর তীর ছিল মিলনস্থল, শিশুদের খেলার জায়গা, শ্রুতিমধুর নৈসর্গিক দৃশ্যের অংশ।
গবেষণায় বলা হয়েছে, নদীর তলদেশ ভরাট, অবৈধ বসতি ও বর্জ্য প্রবাহের কারণে নদীর পানি ও জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
অবনতি: যুদ্ধ নয়, ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে
নদী একসময় রঙিন জীবনের উৎস ছিল—আজ তা প্রায় নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। কয়েকটি মূল কারণ নিম্নরূপ:
- অবৈধ দখল ও ভরাট: নদীর তীর ও নিকটবর্তী অনেক এলাকা দখল হয়ে গেছে।
- বর্জ্য ও দূষণ: আবাসিক ও বাণিজ্যিক বর্জ্য নদীতে প্রবাহিত হচ্ছে, কারখানার অবৈধ বর্জ্য পদার্থও সেখানে মিশে যাচ্ছে।
- নৌচলাচল বন্ধ হওয়া: পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় নৌযান চলে না; নদীর সঙ্গে যোগাযোগ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
- সেচ–প্রবাহের ঘাটতি: প্রধান নদী সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় পানি কমে গেছে।
এই সব কারণে ইছামতির জনদুর্ভোগ বাড়ছে—মাছের সংকট, পরিবহনে বাধা, তীরের সুষ্ঠু ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে।
বর্তমান উদ্যোগ: পুনরুদ্ধারের পথে এক শক্তিশালী পদক্ষেপ
ভালো সংবাদ হলো, নদীকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ:
- ১৫৫৪ কোটি টাকার “ইছামতি নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প” অনুমোদন করা হয়েছে।
- খনন ও উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে—দিনে দিনে নদীর তীর ও খনন প্রকল্প এগিয়ে চলছে।
- প্রকল্পে রয়েছে—৩৩.৭৭২ কিলোমিটার নদীর মুখ খনন, লিংক খাল পুনরায় চালু, বেড়িবাঁধ, ওয়াকওয়ে, গ্যাট নির্মাণ ও গাছ লাগানো।
এই উদ্যোগ শুধু পরিবেশসচেতন নয়, স্থানীয়দের জীবিকা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
চ্যালেঞ্জ ও বাধাসমূহ
যদিও উদ্যোগ চলছে, তবু সফলতা সহজ নয়। কিছু বড় বাধা নিচে দেওয়া হলো:
- দখলদারদের মামলা ও বিরোধ: দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান, পুরনো উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
- সচেতনতার অভাব: নদীর গুরুত্ব সম্পর্কে স্থানীয়দের মধ্যে পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই।
- অপরিকল্পিত নগরায়ন ও বর্জ্য প্রবাহ: দখল বন্ধ হয়নি; নগর উন্নয়ন ও নদীর তীর সংরক্ষণ একসঙ্গে করা প্রয়োজন।
- অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ: বড় প্রকল্প হলেও সময়মত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও সমাধান
নদীকে নতুন রূপে সজীব করে তুলতে কিছু সুপারিশযোগ্য পন্থা রয়েছে:
- নদীর তীরবর্তী এলাকা উন্নয়ন: ওয়াকওয়ে, গ্যাট, বাগান, বিনোদনমূলক স্পট তৈরি করে নদীতীরকে জনপ্রিয় স্থানে পরিণত করা।
- জল-চলাচল পুনরায় শুরু: নৌচলাচল চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতি ও পরিবহন জীবনে প্রাণ ফিরবে।
- মৎস্যসম্পদ রক্ষা ও পুনরুদ্ধার: মাছ ও অন্যান্য জলজ জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা।
- সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ শিক্ষা: স্কুল, কলেজে নদী রক্ষা বিষয়ে পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালানো।
- অবৈধ দখল হটিয়ে নদীর মূল আকৃতি ফিরিয়ে দেওয়া: দ্রুত ও ন্যায়সঙ্গতভাবে দখলমুক্ত ভূমিতে পুনরুদ্ধার কাজ সম্পন্ন করা।
এইসব উদ্যোগ একসাথে বাস্তবায়িত হলে ইছামতি ফিরে পাবে তার প্রাক্তন গৌরব—পাবনার শহর আবার নদীর সঙ্গে নতুন রূপে মিলিত হবে।
ইছামতি নদী শুধু একটি জলপ্রবাহ নয়—এটি একটি জনপদের প্রাণ, প্রকৃতি ও সভ্যতার প্রতিচ্ছবি। এটি কোনো হারিয়ে যাওয়া প্রেত নদী নয়, বরং পুনরুজ্জীবনের প্রত্যাশায় সজীব এক স্রোত। জনগণ, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণে এই নদী আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে। পাবনার মানুষ সেই দিন দূরে নয় বলে বিশ্বাস করে। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে—যেখানে পাখি, মাছ, নৌকা, হাঁটা, আলো—সবই আবার বাসা বাঁধবে। ইছামতি নদী থাকবে না শুধু অতীতের স্মৃতিতে, বরং ভবিষ্যতের জীবন্ত অংশ হিসেবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 





















