ভয়ের সঙ্গে কাটানো প্রতিদিন
আলাবামার হান্টসভিলে বসবাসরত চেলসি ব্রান্টি–বারোহাস এবং তাঁর স্বামী আন্তোনিও বারোহাস সোলানো প্রতিদিন কৃতজ্ঞ থাকেন—তারা এখনো একসঙ্গে আছেন। কিন্তু এই কৃতজ্ঞতার মাঝেই ছায়া ফেলে আছে ভয়—আন্তোনিওকে হয়তো আবার আটক করবে মার্কিন অভিবাসন দপ্তর (আইসিই) এবং ফেরত পাঠাবে মেক্সিকোতে।
রবিবার সকালে তাদের ঘরে ছিল অন্য দিনের মতোই স্বাভাবিক পরিবেশ—ছয় সন্তানের জন্য নাস্তা, রান্নাঘরে কফি, বসার ঘরে ভিডিও গেম, পেছনের উঠোনে ফুটবল খেলা। কিন্তু একই সময় চেলসি আতঙ্কে গ্যারেজে ৪০ গ্যালনের একটি পাত্রে পোশাক ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন—যদি আইসিই হঠাৎ এসে তাঁর স্বামীকে নিয়ে যায়।
“সে অপরাধী নয়,” বললেন চেলসি, চোখ ভরা উদ্বেগে। “যে ধরনের মানুষদের বহিষ্কার করা হচ্ছে, আন্তোনিও তেমন নয়।”
আইনি প্রক্রিয়া ও ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোরতা
চেলসি ও আন্তোনিওর গ্রিন কার্ডের আবেদন প্রক্রিয়া চলছে এমন সময়েই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু করেছেন লক্ষাধিক অভিবাসী বহিষ্কারের অভিযান। আগস্টে এক আকস্মিক ঘটনায় আন্তোনিওকে আইসিই আটক করে ছয় সপ্তাহের জন্য। তাতে স্থবির হয়ে যায় তাদের আইনি অগ্রগতি।

আন্তোনিও ১৪ বছর বয়সে চাচার হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং এরপর থেকে নির্মাণ ও ল্যান্ডস্কেপিংয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০২২ সালে চেলসির সঙ্গে বিয়ে হয়, দুই বছরের কন্যা কোলেটকে নিয়ে গড়ে ওঠে তাদের মিশ্র পরিবার। আইনি কাগজ জমা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকতেই তাঁকে আটক করা হয়।
পরে আদালত ৫,০০০ ডলারের বন্ডে মুক্তি দেয়, কিন্তু আইসিই আবারও তাঁর মুক্তির বিরুদ্ধে আপিল করে। ২৯ অক্টোবর তাঁকে পুনরায় হাজির হতে বলা হয়েছে বার্মিংহামে—যা তাঁদের বাসা থেকে দুই ঘণ্টার দূরত্বে। এখন প্রতিটি সাধারণ দিনই তাদের কাছে এক অদ্ভুত আশীর্বাদ ও আতঙ্কের মিশ্র অনুভূতি।
আকস্মিক সাক্ষাৎ ও গ্রেপ্তার
৬ আগস্ট, কাজ শেষে আন্তোনিও তাঁর আত্মীয়দের বাড়িতে যান—তাঁদের দুই কাজিন গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন, সমবেদনা জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখেন পুলিশ ঘিরে রেখেছে জায়গাটি। ভেবেছিলেন দুর্ঘটনার তদন্ত চলছে। পরে জানা যায়, আইসিই আসলে একজন অপরাধী খুঁজতে এসেছে, যিনি ঐ ঠিকানায় থাকতেন।
তারা যখন উপস্থিত প্রতিটি হিস্পানিক পুরুষের পরিচয়পত্র চাইতে শুরু করে, আন্তোনিও জানায় সে একজন মার্কিন নাগরিকের স্বামী, আইনজীবীর সহায়তায় বৈধতার প্রক্রিয়ায় আছে। কিন্তু আইনি রেকর্ডে কোনো অপরাধ না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চেলসি বলেন, “আমি তাঁর ফোনে কল দিচ্ছিলাম, কিন্তু কেউ ধরছিল না। বাচ্চারা গাড়িতে বসে কাঁদছিল—‘বাবা কোথায়?’ আমি জানতাম কিছু একটা ঘটেছে।”
ভালোবাসা, বিশ্বাস আর অজানার জন্য প্রস্তুতি
চেলসি ও আন্তোনিও ২০২০ সালে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত হন। দুজনেই ছিলেন একক অভিভাবক, পরিবারকেন্দ্রিক জীবনবোধে মিল পান। আন্তোনিও সন্তানদের যত্ন নিতেন, নিয়মিত খোরপোষ দিতেন, মদ্যপান করতেন না—এই সরল গুণেই মুগ্ধ হন চেলসি।
“ভালো মানুষ পাওয়া কঠিন, বিশেষত সন্তান থাকলে,” তিনি বলেন। আন্তোনিও যোগ করেন, “ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ, তিনি তাঁকে আমার জীবনে এনেছেন।”

রবিবার সকালে চেলসি গুছোচ্ছিলেন—সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য। মেক্সিকো সম্পর্কে তাঁর খুব সামান্যই ধারণা; ভাবতেও পারেন না, স্বামীর পাহাড়ি গ্রামে গিয়ে কেমন জীবন হবে। কিছু কাপড়, হিটার, কফি মেশিন আর ৮০টা কফি ক্যাপসুল গুছিয়ে রেখেছেন—“ওখানে যদি এগুলো না পাই।”
চেলসির নিজেরও স্বাস্থ্য সমস্যা—তিন মাস পরপর অস্ত্রোপচার করতে হয় টিউমার অপসারণের জন্য। বড় মেয়ে কামিলের মস্তিষ্কে টিউমারজনিত খিঁচুনি রয়েছে, যার জন্য তাঁকে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছেই থাকতে হয়।
নতুন নীতির নীরব প্রভাব
ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতি শুধু বড় আকারের অভিযানেই সীমাবদ্ধ নয়; নীরবে কিছু আইনি পরিবর্তনও ঘটেছে। আদালতের রায় অনুযায়ী, আইসিই এখন অভিবাসন বিচারকদের জামিন প্রদানের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করছে।
“ম্যাটার অব ইয়াজুরে হার্টাডো” নামের এক মামলায় ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তি দিয়েছে—যাঁরা অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের জামিন দেওয়া যাবে না। বোর্ড অব ইমিগ্রেশন আপিলস এই ব্যাখ্যায় সম্মতি জানিয়েছে।
আন্তোনিওর ক্ষেত্রে বিচারক বিকল্প ব্যবস্থার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেমন পায়ের মনিটর ব্যবহার। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এসব বিকল্প ব্যবস্থাও সীমিত করে দিয়েছে। অবশেষে তাঁকে কোনো মনিটর ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয়।
চেলসির বাবা-মা ১২ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে মিসিসিপির অ্যাডামস ডিটেনশন সেন্টার থেকে তাঁকে নিয়ে আসেন। তখন তিনি অসুস্থ, ওজন কমে গেছে, হাতে পরেছিলেন নীল ব্রেসলেট—একজন নেপালি বন্দি বানিয়ে দিয়েছিল তাঁদের মেয়ে কোলেটের নামে।
পরিবারের আবেদন: ‘আমরা শুধু দয়া চাই’
স্বামী আটক হওয়ার পর চেলসি স্থানীয় সিটি কাউন্সিলে চিঠি লিখেছিলেন সহায়তা চেয়ে, কিন্তু কোনো সাড়া পাননি।
“দক্ষিণে অভিবাসীদের নিয়ে মানুষের কথা শোনলে ভয় হয়,” তিনি বলেন।

ছোট মেয়ে কোলেট বাবার আঁকা লাল নখ দেখিয়ে খুশিতে বলে উঠল, “ড্যাডিই রঙ করেছে!”—সেই মুহূর্তে কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে চেলসির, “আমরা শুধু দয়া চাই। আমরা শুধু পরিবার হিসেবে একসঙ্গে থাকতে চাই—আইনি পথে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে চাই, যেন তাঁকে অপরাধীর মতো আটক না করা হয়।”
আন্তোনিও স্ত্রীর হাত ধরেন, ধীরে বলেন, “এখন সবকিছু তাদের হাতে। হয়তো আমাকে থাকার সুযোগ দেবে, হয়তো না।”
#মার্কিনঅভিবাসন #ট্রাম্পনীতি #আইসিই #আলাবামা #অভিবাসীবিশ্বাস #পরিবারসংগ্রাম #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















